হাসিনা-ড. কামাল ‘বোমা ফাটাচ্ছেন’ ভারতীয় গণমাধ্যমে, কেন?

নির্বাচনি প্রচারণার উত্তুঙ্গ সময়ে বাংলাদেশের ভিআইপি রাজনীতিবিদরা মুখ খুলছেন ভারতের গণমাধ্যমের কাছে। বৃহস্পতিবার (২৭ ডিসেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামালকে পর্যন্ত খোলামেলা মন্তব্যে পাওয়া গেল ভারতীয় গণমাধ্যমে। তাঁরা এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা দেশের প্রচলিত গণমাধ্যমে করতে দেখা যায়নি। এ ব্যাপার অনুসন্ধান করলে এর কারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষকরা।

- Advertisement -

বৃহস্পতিবার ২৭ ডিসেম্বর ভোর পৌনে ৫টায় ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে এক এক্সক্লুসিভ রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন ড. কামাল। সাংবাদিক শুভজিত রায়কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এবার নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে জামায়াত নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া বোকামি হয়েছে।

- Advertisement -google news follower

হাসিনা-ড. কামাল ‘বোমা ফাটাচ্ছেন’ ভারতীয় গণমাধ্যমে, কেন? | Indian Media 2.gif

ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, জামায়াত নেতারা ধানের শীষ নিয়ে প্রার্থী হবে জানলে ঐক্যফ্রন্টের দায়িত্ব নিতাম না।’

- Advertisement -islamibank

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীর ২২ জন নেতার বিএনপির প্রতীকে নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রশ্নের উত্তরে কামাল হোসেন বলেন, ‘দুঃখের সঙ্গে আমাকে বলতে হচ্ছে জামায়াত নেতাদের মনোনয়ন দেওয়াটা বোকামি। আমার সঙ্গে লিখিত চুক্তি হয়েছে যে, জামায়াতকে কোনও সমর্থন দেওয়া এবং ধর্ম, মৌলবাদ, চরমপন্থাকে সামনে আনা যাবে না।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘যদি জানতাম জামায়াত নেতারা বিএনপির প্রতীকে নির্বাচন করবেন, তাহলে আমি আজ এতে থাকতাম না। ভবিষ্যৎ সরকারে যদি জামায়াত থাকে, তাহলে আমি তাদের সঙ্গে একদিনও থাকব না।’

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক ড. কামালের মুখ থেকে রীতিমতো জাদুর টোপ দিয়ে বের করে আনলেন থলের বিড়াল- ’বিএনপি-জামায়াত জোট ২০০১ সালে দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে অভিযুক্ত।

ড. কামালের সরল স্বীকারোক্তির আগে সারাদিন চাউর ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরেকটি মন্তব্য। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ক্ষমতায় আমরাই আসছি ফের, মানুষ আমাদের চাইছেন’।

হাসিনা-ড. কামাল ‘বোমা ফাটাচ্ছেন’ ভারতীয় গণমাধ্যমে, কেন? | Indian Media 1 1

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বৃহস্পতিবার ছিল শেখ হাসিনার শেষ কর্মদিবস। সেই দিনই আনন্দবাজারে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

ধানমণ্ডির সুধাসদনে নিজ রাজনৈতিক কার্যালয়ে বসে আনন্দবাজার অনলাইনের অঞ্জন রায়কে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের উপর আমার বিপুল আস্থা। মানুষ আমাদের সঙ্গে রয়েছে। জনগণের ভোটেই আমরা নির্বাচিত হবো।’

স্কুপ সাক্ষাৎকারে টিকাটিপ্পনি কাটতেও ভুলেননি শেখ হাসিনা। প্রতিপক্ষ কামাল হোসেনের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে হাসিনা বলেন, কামাল হোসেনকে দেশের সংবিধান রচয়িতা বলা হয়। তিনি আওয়ামী লীগ থেকে চলে গিয়ে নিজে দল করেন। ধানমণ্ডি থেকে দাঁড়িয়েছিলেন একবার। ওই নির্বাচনে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। সেই তিনি কিনা গেলেন জামায়াত-বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে! আমি অবাক হইনি। কারণ কী জানেন? তাঁর শ্বশুরবাড়ি পাকিস্তানে। ছেলেদের একটু শ্বশুরবাড়ির টানটা বেশি থাকে।’

প্রশ্ন হলো, এই সরল স্বীকারোক্তি এতদিন বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বের করতে পারলেন না কেন?

জানতে চাইলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার বাংলাদেশ ইনচার্জ ও সিনিয়র সাংবাদিক অনমিত্র চট্টোপাধ্যায় জয়নিউজকে বলেন, ভারতের সাংবাদিকরা যখন বাংলাদেশের কোনো নেতা নেত্রীকে প্রশ্ন করেন, তখন কেবল প্রশ্নই করেন, এতে কোন স্তুতি বা প্রশংসা থাকে না। আমি মনে করি, কোনো গণমাধ্যম যখন ক্ষমতাকাঠামোর কাছে নতজানু থাকে, তখন প্রশ্নের বদলে সারাক্ষণ প্রশংসা ফুটে উঠে। স্তুতি করে নজরে পড়াটা অনেকেই উত্তম পথ বলে ভাবেন।

এর আগে গত মে মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দু’দিনের ভারত সফরে আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম ছিল- দিল্লির পাশে থেকেছে ঢাকা, মোদীর কাছে ‘প্রতিদান’ চান হাসিনা।

আনন্দবাজার খোলাখুলি লিখেছিল, ‘মোদীর সঙ্গে বৈঠকে হাসিনা জানিয়েছেন- তাঁর সরকার উত্তর-পূর্বের জঙ্গিদের দেশছাড়া করেছে, ট্রানজিট দিয়েছে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে বরাবর দিল্লির পাশে থেকেছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের বছরে এবার তাই ভারতের সহযোগিতা চাই।’

ভারতের কাছে ‘চোখা উত্তর’ কেন দেন বাংলাদেশের ভিআইপি নেতারা? এ ব্যাপারে অনমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলাদেশের একশ্রেণীর সাংবাদিকদের মধ্যে রাজনৈতিকচর্চা রয়েছে যা গণমাধ্যমের জন্য শুভ নয়। সাংবাদিকদের বিভক্তির কারণে শাসকদল সবসময় মিডিয়াকে চেপে ধরার সুযোগ পায়। ফলে স্তুতি করতেই দিন চলে যায়, স্কুপ বের করা যায় না।’

এ ব্যাপারে আমরা কথা বলেছি বাংলাদেশের মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজমের অন্যতম প্রবক্তা আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। তিনি বার্তা টুয়েন্টিফোর ডট কমের সম্পাদক। জয়নিউজকে তিনি বলেন, নির্বাচনের দুই দিন আগে দুটি ভারতীয় গণমাধ্যমের কাছে স্কুপ নিউজ তুলে ধরার মধ্যে আমি নতুন কোনো ব্যাপার দেখছি না। আমি নিজেও দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকাসহ বহু আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থায় বাংলাদেশ থেকে সংবাদ পরিবেশন করেছি। নির্বাচনের মতো উপলক্ষ এলে এরকম স্কুপ নিউজ করার পরিবেশ তৈরি হয়। মাল্টিমিডিয়া বা ডিজিটাল সাংবাদিকতার প্রসারের কারণে এখন এইরকম সংবাদগুলোর পরিবেশন, পাঠকপ্রিয়তা এবং ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ভারতের সাংবাদিকরা এই সুযোগ মিস করছে না।

কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ ফরিদুল আলমের সঙ্গে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, ভারতীয় গণমাধ্যম যেভাবে ড. কামাল এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে ‘উত্তর’ বের করে আনলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা তা পারছেন না কেন? তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রফেশনাল সাংবাদিকতার অভাব আছে, ফলে স্কুপ সাংবাদিকতা এখন নেই বললেই চলে। এছাড়াও সাংবাদিকদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তি এখন প্রকট। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় একটি প্রবণতা ভীষণভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা হলো ক্ষমতাকাঠামোর সাথে যুক্ত থাকা। যাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিদ্যায়তনিক আলোচনায় বলা হচ্ছে এমবেডেড জার্নালিজম। একদিকে এমবেডেড জার্নালিজমের মাধ্যমে সাংবাদিকরা ক্ষমতা কাঠামোকে প্রশ্ন করতে পারছেন না, আবার ভয়ের সংস্কৃতিতে তাড়িত হয়ে অনেকেই প্রশ্ন করাটাই ভুলে যাচ্ছেন। ফলে নিরাপদ জায়গায় থেকে দায়সারা কর্তব্য পালনে অভ্যস্ত হলে সাংবাদিকতা পেশাগত ভিত্তিটা হারায়।

এ ব্যাপারে জয়নিউজ কথা বলেছে বাংলাদেশের সদ্য বাজারে আসা দৈনিক দেশ রূপান্তর সম্পাদক অমিত হাবিবের সঙ্গে। অমিত হাবিব বাংলাদেশে তুলনামূলক অর্থে তরুণ সম্পাদক, যিনি ২০০৭ সালে চীনের আন্তর্জাতিক বেতারে বিদেশি বিশেষজ্ঞ হিসেবেও কাজ করেছিলেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এভাবে স্কুপ উত্তর বের করে আনতে পারলে তো ভালোই হতো। আমাদের মধ্যে যে চেষ্টার ত্রুটি আছে সেটা ধরা পড়ে। ভারতের সাংবাদিকরা নির্বাচনের সময় একটি এসাইনমেন্ট নিয়ে আসে, তারা চেষ্টা করে এবং সেটা তাদের কাজেকর্মে ধরা পড়ে। আমরা তুলনামূলক অর্থে উপরিতল প্রতিবেদনে (ভাসা ভাসা) সন্তুষ্ট থাকি। এটা একটা সংকট।

 

হাসিনা-ড. কামাল ‘বোমা ফাটাচ্ছেন’ ভারতীয় গণমাধ্যমে, কেন? | 47571791 10216583161345503 8077404457962307584 n

লেখক: রাজীব নন্দী
সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চবি
পরামর্শক, জয়নিউজ

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM