যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই… সাতসকালে গানটা শুনতেই মনটা একটু আনমনা হয়ে গেল। ১৫ আগস্টের খুবই পরিচিত এক গান। অলি-গলি থেকে রাজপথ, সবখানেই বাজানো হয় গানটি। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
আজ ১৫ আগস্ট; স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী। বাঙালির শোকের দিন। আমার কাছে দিনটি শুধু শোকের নয়, শক্তিরও। যে শক্তি আমাদের দিয়ে গেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭৫ সালের এই দিনে সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও বিপথগামী সদস্য ধানমণ্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ঘাতকেরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্তবাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, আবদুল নাঈম খান রিন্টু, কর্নেল জামিল।
ঘাতকের হামলা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ওই সময় স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে সন্তানসহ জার্মানি অবস্থান করছিলেন শেখ হাসিনা। সেখানে বড় বোনের সঙ্গে ছিলেন শেখ রেহানাও।
ওইদিন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে কাপুরুষোচিত হামলা চালায় ঘাতকরা। এ নারকীয় হামলায় ভবনের প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো। গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল দেওয়াল।
চারপাশে রক্তের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ। তাঁর তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁজরা। পাশেই পড়ে ছিল তাঁর ভাঙা চশমা ও তামাকের পাইপ।
ষড়যন্ত্রকারী ও ঘাতকরা চেয়েছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিতে। কিন্তু যে নাম প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে আছে সে নাম যে মুছে ফেলা যায় না ঘাতকেরা তা বুঝতে পারেনি।
খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যার ডাক নাম ছিল খোকা।
ছাত্রাবস্থায় খোকা জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন সংগ্রামী নেতা। বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ ছয় দফার প্রণেতাও ছিলেন তিনি। ১৯৭০-এর নির্বাচনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে এ দেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত করেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উত্তাল সমুদ্রে বজ্রদৃপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এ ঘোষণায় উজ্জীবিত বাঙালি জাতি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ে। ছিনিয়ে আনে লাল-সবুজের পতাকা। জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি এ স্বাধীন বাংলাদেশ।
যেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধু
একজন ব্যক্তি কেমন তা তাঁর কথাবার্তা ও জীবনযাপনই প্রমাণ করে। আজীবন সংগ্রামী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির প্রতিটি লড়াই-সংগ্রামে অগ্রে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
গণআন্দোলন ছাড়া, গণবিপ্লব ছাড়া বিপ্লব হয় না- এমনটিই মনে করতেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বীরই বলতে পারেন- যে মানুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তত, কেউ তাকে মারতে পারে না।
নিজ দেশের জনগণের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছিল তাঁর। তাইতো তিনি বলেছিলেন- সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না। আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার দেশের মানুষকে ভালবাসি, সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশি ভালবাসি।
লোভ-লালসা কখনো স্পর্শ করতে পারেনি বঙ্গবন্ধুকে। তাইতো তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন- প্রধানমন্ত্রী হবার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। প্রধানমন্ত্রী আসে এবং যায়। কিন্তু যে ভালোবাসা ও সম্মান দেশবাসী আমাকে দিয়েছেন, তা আমি সারাজীবন মনে রাখবো।
সব ধর্মের প্রতি সমান সম্মান ছিল বঙ্গবন্ধুর। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন- “সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।”
বঙ্গবন্ধুই ঘোষণা দিয়েছিলেন- ”বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবেই।” বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন করছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিশ্বজুড়ে বঙ্গবন্ধু
অসীম সাহস ও দেশপ্রেমের জন্য বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিশ্বনেতাদের কণ্ঠেও ভেসে উঠেছে বঙ্গবন্ধুবন্দনা।
কিউবার লৌহমানব ফিদেল কাস্ত্রোর বিখ্যাত সেই উক্তি এখনো বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করে- “আমি হিমলায় দেখিনি কিন্তু মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তিনি হিমালয়”।
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, “শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তাঁর অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।”
আর ভারতের সাবেক রাষ্টপ্রতি প্রণব মুখার্জীর কাছে তো বঙ্গবন্ধু বিশেষ কিছু। তাঁর মতে, “বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সাহসী নেতা।”
তবে অবাক হতে হয় পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের মন্তব্যেও- “শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী ছিলেন না, কিন্তু তাঁকে সেই পথে যেতে বাধ্য করা হয়।”
বঙ্গবন্ধুর কোমল হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ইয়াসির আরাফাতের মন্তব্যে। তাঁর মতে, “আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুমকোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।”
তবে সবার উক্তি ছাপিয়ে কঠিন সত্যটা তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছর নিষিদ্ধ ছিল ৭ই মার্চের ভাষণ। রেডিও-টিভিতে এই ভাষণ প্রচার করা হতো না কখনো। অনেকেই মাইকে এই ভাষণ প্রচার করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন। আজ সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ১২টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে, আড়াই বছরের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।”
শেষ কথা
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলে শেষ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু একজন সত্যিকারের বীর, যাঁর কাছে সর্বাগ্রে ছিল দেশপ্রেম। হাজার বছরের এই শ্রেষ্ঠ বাঙালি আজীবন শুধু দিয়েই গেছেন, বিনিময়ে চাননি কিছুই। ২০১৭ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেস্কো যেন এই আত্মত্যাগেরই স্বীকৃতি দিল।
বঙ্গবন্ধু- যিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন সোনার বাংলা গড়ার। বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলার গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ১৬ কোটি বাঙালি, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ১৬ কোটি বাঙালির প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অসংখ্য সফলতাকে সঙ্গী করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পথেই হাঁটছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
লেখক: সম্পাদক, জয়নিউজ।