ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। এক সহজ সরল শিক্ষিত জীবনযাপনের অসাধারণ জনপদ ত্রিপুরা। বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া সীমান্তঘেঁষা ছিমছাম সবুজ নৈসর্গিক এ ভূমির মানুষের মুখের ভাষাও বাংলা। প্রতিবেশী বাংলাদেশের নিকটতম আকর্ষণ এই এলাকা। সম্প্রতি আগরতলা পরিদর্শনে গিয়ে সেখানকার এক চমৎকার বিশ্ববিদ্যালয় দেখার সুযোগ হলো। নাম তার ইকফাই বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি ড. বিপ্লব হালদারের আমন্ত্রণে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার সুযোগ হলো। প্যারামেডিক্যাল সায়েন্সের প্রফেসর সৌমেন মুখার্জি বিশেষ অনুরোধ করেছিলেন যোগাযোগবিদ্যার ওপর দু’টি বিশেষ বক্তৃতা দিতে। ফলে শিক্ষার্থীদের সাথে চমৎকার দু’টি বেলা কেটেছে ওখানে।
বাংলাদেশের আখাউড়া স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন শেষ করে ভারতে প্রবেশ করলেই আগরতলা শহর। আখাউড়া রেল স্টেশন নেমে ১৫-২০ মিনিটেই দেড়শ’ টাকায় রিজার্ভ সিএনজিতে পৌঁছে যাওয়া যায় আখাউড়া স্থলবন্দর চেকপোস্টে। চেকপোস্ট থেকে ইমিগ্রেশন শেষ করে একঘণ্টা পর এই অপরূপ ক্যাম্পাস।
ছায়া সুনিবিড় ও প্রাকৃতিক নৈসর্গের ক্যাম্পাস ইকফাই বিশ্ববিদ্যালয়। আগরতলা সিটি সেন্টার, উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ, আগরতলা রেল স্টেশন, উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের দিগন্ত, উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ কমপ্লেক্স, উত্তরী প্রবেশদ্বার, কালীমন্দির- প্রসিদ্ধ স্থাপনাগুলো রয়েছে ক্যাম্পাসের আশপাশেই। এই এলাকায় সাক্ষরতার হার ৮৫% । এটি পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার মোহনপুরের কমলঘাটে অবস্থিত।
প্রোভিসি ড. বিপ্লব হালদার বলেন, ক্যাম্পাসটির অনন্য দিক হলো এটি অল ইন্ডিয়া ক্যাম্পাস। বহুভাষী শিক্ষার্থীদের কারণে এখানে পুরোপুরি ইংরেজি ভাষায় পাঠদান হয়। এছাড়াও আবাসিক সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে নামমাত্র মূল্যে।
জানা গেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ক্যাম্পাসজুড়ে রয়েছে ফ্যাকাল্টি অব ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ, সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, ল স্কুল, ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন, লাইব্রেরি এন্ড ইনফরমেশন সায়েন্স, হিউমেনিটিজ এন্ড সোশ্যাল সায়েন্স, স্পেশাল এডুকেশন এন্ড রিহেবিলিটেশন, এডুকেশন এন্ড ইয়োগা এবং প্যারামেডিক্যাল সায়েন্স। আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতির প্রায় সব উপাদান নিয়েই এখানকার ক্লাশরুমগুলো সাজানো হয়েছে। রয়েছে সুপরিসর আবাসিক হল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুখর এই ক্যাম্পাসের আয়তন রীতিমতো তাক লাগানো।
ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. প্রিয়াংশু রানা বড়ঠাকুর। ভারতের আসাম এলাকার স্মিতহাস্য মানুষটি জানালেন তাঁর স্বপ্নের কথা। ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর প্রিয়াংশু জানালেন, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির সাথে দুই বাংলার মেলবন্ধন ঘটাতে চাই। এতে লাভবান হতে পারে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীরা। বছরজুড়ে সেমিনার, কনফারেন্সসহ নানা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে দুই বাংলার সম্মিলন ঘটানোর সুযোগ রয়েছে এখানে।
ঢাকা বা চট্টগ্রাম, যে কোনো দিক থেকে থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টার দূরত্বে দেশের বাইরে পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা এই ত্রিপুরা। এই রাজ্যের সরকারি ভাষা বাংলা ও ককবরক। ‘ত্রিপুরা সুন্দরী’র নামানুসারে এই জনপদের নাম ত্রিপুরা। যেখানে রয়েছে চমৎকার এক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আগরতলা থেকে অনেক সরকারি ও বেসরকারি বিমানসংস্থা নিয়মিত বিমান চালনা করে থাকে এখানে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্রিপুরা রয়েছে স্মারক হিসেবে। তখন বাংলাদেশ থেকে পাড়ি দেওয়া শরণার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় চৌদ্দ লক্ষ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বরপুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল ত্রিপুরার। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেক সাধারণ মানুষেরই ঐতিহ্য ও শেকড় বাংলাদেশ! ইকফাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি ড. বিপ্লব হালদারের শেকড়ও বাংলাদেশের বরিশালে। তাই বাংলাদেশের মানুষ দেখলে হাসিমুখে জড়িয়ে ধরেন তিনি। বিদায়বেলায় দু’হাত বাড়িয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম চট্টগ্রাম বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার সবসময় খোলা এই ক্যাম্পাসে।
বিকেলের আলো পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লে বিদায় জানালাম ক্যাম্পাসটিকে। সুবিশাল প্রবেশদ্বারে পড়ন্ত সূর্যের আলো দেখে মনে হচ্ছিল, যেন ত্রিপুরারই আলো ইকফাই বিশ্ববিদ্যালয়!
লেখক: রাজীব নন্দী
সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
পরামর্শক সম্পাদক, জয়নিউজবিডি