হাটহাজারী উপজেলা সদর থেকে উত্তরে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে কাটিরহাট। এখান থেকে ইট বিছানো সড়ক ধরে পশ্চিমে প্রায় ছয় কিলোমিটার। তার পশ্চিমে ১ নম্বর ফরহাদাবাদ ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের একেবারে শেষপ্রান্তে আরও প্রায় এক কিলোমিটার মেঠোপথ। তারপর পাহাড়ের ভাঁজে দেখা মেলে দুর্গম এক জনপদের। যে জনপদটির নাম ‘সোনাই ত্রিপুরা পল্লী’।
পাহাড়ে ও বনাঞ্চলে বসবাস করা ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করে। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের অন্বেষণে এসব পরিবারের নারী-পুরুষকে হিমশিম খেতে হয়। সম্প্রতি হাম-এ অক্রান্ত হয়ে একই পরিবারের তিন জনসহ ৪ শিশুর মৃত্যু এবং ১ প্রসূতিসহ ৮ মাস থেকে ১০ বছরের ২৪ শিশুর অসুস্থ হওয়ার পর উন্মোচিত হয় সোনাই ত্রিপুরা পল্লীর দুঃখগাথা।
কয়েকদিন ধরে ত্রিপুরা পল্লীর প্রতিটি ঘরে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা এ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খোঁজখবর নিচ্ছে। আগে এমনটা হয়নি বলে জানান পল্লীর ৫০ বছর বয়সী শাম ত্রিপুরা। শুধু শাম ত্রিপুরা নয়, স্থানীয় ফুলমতি ত্রিপুরা, শান্ত ত্রিপুরা, নিশিরং ত্রিপুরা ও ধনপতি ত্রিপুরা জানান, সরকারি সংস্থার কেউ কোনোদিন এ পাড়ায় এসে টিকা দেয়নি। পল্লী থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে হওয়ায় ফরহাদাবাদ উদালিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে যেতে পারি না।
৪৫ বছর বয়সী লক্ষ্মী কুমার ত্রিপুরা জয়নিউজকে বলেন, চার শিশুর মৃত্যুর পর এই প্রথম ভদ্রলোকদের (স্বাস্থ্যকর্মী) পা পড়েছে ত্রিপুরা পল্লীতে। গত ৪৫ বছরে এভাবে পাড়াতে এসে সেবা দেয়নি কেউই। তাদের নির্ধারিত স্থান ছাড়া অবহেলিত এই এলাকায় এসে কেউই টিকা দেয় না। তিনি আরো বলেন, দুর্গম এ পল্লীতে যদি একটি ক্লিনিক স্থাপন করা হতো, তাহলে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হতো না এ দরিদ্র মানুষগুলো।
তিনি আরো বলেন, টিকা দেওয়ার সময় এলে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাঝে মাঝে মাইকিং হয়। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের এখানে নারী-পুরুষ সবাই কৃষি ও জুমচাষে ব্যস্ত থাকে। তাই অধিকাংশ শিশু টিকা পায় না। আমরা অশিক্ষিত মানুষ, আমাদের এখানে যদি তারা (স্বাস্থ্যকর্মীরা) না আসে, তাহলে পল্লীর লোকজন কিভাবে সচেতন হবে!
সরেজমিনে মঙ্গলবার (২৮ আগস্ট) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ত্রিপুরা পাড়ায় প্রবেশ করলে চোখে পড়ে স্বাস্থ্য বিভাগের একটি দল কোন পরিবারে কারা টিকার বাইরে আছে তা নথিভুক্ত করছে। মহিলাদের মাঝে ভিটামিন ক্যাপসুল বিলি করতে দেখা গেছে। এ সময় স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, তারা বাড়ি বাড়ি এসে সেবা প্রদান করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ত্রিপুরা পল্লীর মহিলারা কাজে চলে যাওয়ায় আমাদের সাথে তাদের দেখা হয় না। এতে সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ফলে বাল্যবিবাহ ও অধিক সন্তান গ্রহণ ত্রিপুরা পল্লীতে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী এ প্রতিবেদককে জানান, ত্রিপুরা পল্লীতে বসবাসকারীরা জীবন-জীবিকার তাগিদে পাহাড়ে কখনও জুম, কখনও কাঠ সংগ্রহ করতে চলে যায়। যখন টিকা দেওয়ার সময় তখন তারা পল্লীতে থাকে না। সে কারণে হয়তো তারা টিকা কার্যক্রম থেকে বাদ পড়ছে। তাই হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে ত্রিপুরা পল্লীতে ছয় মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের তালিকা করে তাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেওয়া হবে। তারা সকলেই টিকা নিয়েছে কি না তা দেখা হবে।
জয়নিউজ/আরসি