পাহাড়ি ছায়ায়-মায়ায় যে চট্টগ্রাম দেশের মধ্যে একক ও অনন্য, সেই চট্টগ্রামের টাইগারপাস পাহাড়কে আড়াল করার এক উন্নয়নযজ্ঞ সামনে এসেছে। টাইগারপাসের দৃষ্টিনন্দন দুই পাহাড়ের বুক চিরে বসবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। বর্তমানের বহমান রাস্তাটির উপর হবে আরো একটি উড়াল সড়ক। অথচ এই টাইগারপাসকে ঘিরেই হতে পারে সবুজ এক নান্দনিক বিনোদনকেন্দ্র। লিখেছেন জয়নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক পার্থ প্রতীম নন্দী, সঙ্গে রইলো জয়নিউজের নিজস্ব আলোকচিত্রী বাচ্চু বড়ুয়ার তুলে ধরা দৃশ্যচিত্র।
টাইগারপাস পাহাড়টি মোটামুটি মাঝারি উচ্চতার সবুজ এক পাহাড়। ছায়া আর মায়ায় মোড়ানো বিশাল এক এলাকা। খানিক দূরেই মিলেছে সিআরবি পাহাড়টি। রাস্তার দুইপাশে ক্লান্ত শরীর নিয়ে হেঁটে চলা পথচারীরা যেখানে নিতে পারেন দু’দন্ড বিশ্রাম।
উড়ালসড়ক হলেই যানজট কমবে, ধারণাটি সহজ হতে পারে, কিন্তু সমীচীন নয়। এ শহরের অনেক স্থানেই প্রকৃতিকে কঠোর শাসন না করে সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে অনন্য স্থাপনা হিসেবে। এক্ষেত্রে জাম্বুরি মাঠ, কর্ণফুলীর চর, ফয়’স লেকের কথা সবার আগে বলতে হয়। এই স্থাপনাগুলি শহরকে উত্তরোত্তর গতিশীল করেছে, করেছে প্রকৃতিমুখি।
টাইগারপাসে হতে পারে অনন্য বিশ্রামাগার। রাস্তায় মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে মাইকে প্রস্তাবটি দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষক মহিউদ্দিন মাহীম। তিনি বলেন, প্রকৃতির সৌন্দর্যকে অবহেলা বা নিষ্ঠুরভাবে শাসন নয়, প্রয়োজন পরিকল্পনা।
আসলেই তাই। নগরের কোলাহল, ব্যস্ততায় তিক্ত-বিরক্ত হয়ে কিছুটা সময় দূরে, নিভৃতে প্রকৃতির কাছাকাছি কাটাতে কার না ইচ্ছে হয়! এমন জায়গায় যেতে পারলে শরীরের ক্লান্তি জুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মনও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। যে শহরে পাহাড় আছে দুই বাহু বাড়িয়ে- সেই শহর যে কাউকে আকর্ষণ করবেই।
টাইগারপাসের নাগালের মধ্যেই এমন বেশ কিছু জায়গা রয়েছে, যেখানে গেলে সন্ধ্যার পর ছোটখাটো কনসার্ট বা সাংস্কৃতিক আয়োজন হতে পারে। বয়স্ক নাগরিকরা বৈকালিক হাঁটা-চলা শেষে জিরিয়ে নিতে পারেন এখানে। বিশেষ করে পাহাড়চূড়া থেকে এক নজরে পুরো শহর দেখার এমন স্থান বন্দরনগরীতে মিলবে খুবই কম।
নান্দনিক টাইগারপাস হতে পারে নগর বিনোদনে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। এখানে হতে পারে দর্শনীয় এক পার্ক। স্থানটি যখন সিআরবি, স্টেডিয়াম, শিশুপার্ক থেকে পাথরছোঁড়া দূরত্বে, পুরো এলাকাকে ঘিরেই হতে পারে একটি পূর্ণাঙ্গ বিনোদনকেন্দ্র।
এখানে রয়েছে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা। বলতে গেলে শহরের ঠিক মাঝখানেই টাইগারপাসের অবস্থান। তাই প্রকৃতিপ্রেমিরা এখানে পৌঁছুতে পারবেন সহজেই।
চট্টগ্রাম দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। এই শহরের যে অনন্য বৈশিষ্ট্য নাগরিকদের মুগ্ধ করে তা হচ্ছে এখানকার প্রকৃতি। এত পাহাড়, এত নদী আর সাগরের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি বাংলাদেশের আর কোন নগরে নেই।
বন্দরনগরে আসলে অবাক হয়ে দেখতে হবে টাইগারপাসের সবুজ পাহাড়ের ছায়া। ভবিষ্যতে বিজ্ঞান অনুসন্ধানী খুদে শিক্ষার্থীদের জন্য এটি হতে পারে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র।
মালয়েশিয়ার প্রখ্যাত গ্যান্টিংহাইল্যান্ডের মতো পরিবেশে পরিবারের সঙ্গে বয়স্ক নাগরিকরা তুমুল আনন্দে সময় কাটাতে পারেন এখানে। সারাদিন কাজ শেষে কর্পোরেট চাকুরেদের জন্য নাইট লাইফও উপভোগ্য হতে পারে এই পাহাড়ের চূড়ায়।
টাইগারপাসের রাস্তার এক কোণে গানের আসর বসাতে পারেন কোনো এক খেয়ালি নাগরিক গায়ক। দিন শেষে মনের আনন্দে যেখানে ভিড় করবেন সংস্কৃতিপ্রেমীরা। পাহাড়ের খাঁজে লাইটের আলোয় কোথাও জাদুকর দেখাতে পারেন ম্যাজিক।
পাহাড়ে চড়ার অসম্ভব সব নৈপুণ্য প্রদর্শনধর্মী প্রশিক্ষণকেন্দ্র খোলা যেতে পারে এখানে। এসব আয়োজন ঘিরেই উৎসুক পর্যটকদের ভিড় সামাল দেওয়া হবে কঠিন এক কাজ।
সবমিলিয়ে প্রতিদিন এই পাহাড়কে কেন্দ্র করে বসতে পারে চমৎকার এক মিলনমেলা। নাগরিক জীবনের এই আয়োজন যেন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তাগিদ যোগায় আনন্দে বেঁচে থাকার, শেখায় কীভাবে উপভোগ করতে হয় নাগরিক সময়, এমনটিই প্রত্যাশা অনেকের টাইগারপাসকে ঘিরে।
টাইগারপাস দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী হাফিজুল হক। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ক্রমেই বসবাস অযোগ্য নগরী হয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম। অথচ পাহাড়-নদী-সমতল-সমুদ্র; প্রকৃতির এই চার আবেষ্টনীর মধ্যে বিশ্বের সেরা শহর হতে পারতো এই চট্টগ্রাম।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, উদ্ভট নগর পরিকল্পনা আর যানবাহন অব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের ক্ষোভের শেষ নেই। টাইগারপাসকে কেন্দ্র করে শিশু বিনোদনকেন্দ্র হলে অফিস শেষে নিজের সন্তানদের নিয়ে কিছু সময় কাটানো যেতে পারে।