সময়টা অবাধ তথ্য প্রবাহের। তথ্য যত দ্রুত সহজলভ্য হবে, সেই সমাজ তত উন্নত হবে। তথ্যবিহীন সমাজে গুজব ছড়ায়। সমাজে অস্থিতিশীলতা বাড়ে। সমাজের স্বাভাবিক তথ্যের চাহিদা মেটাতে তাই যে কোনো সরকারকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
নতুন গঠিত মন্ত্রিসভায় চমক হিসেবে বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সতর্কতার নমুনা প্রকাশ পেয়েছে। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা ও তথ্যপ্রবাহের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ড. হাছান মাহমুদ দায়িত্ব পেয়েছেন তথ্যমন্ত্রীর। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
সাবেক সফল পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর দায়িত্বের পর তথ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনের সাংসদ ড. মো. হাছান মাহমুদ।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভায় প্রথম ৬ মাস পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পর বাকি সময়টুকু সাফল্যের সঙ্গে পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয় ২০১৪ সালে গঠিত সরকারের মন্ত্রিসভায়। কারণ তাঁকে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এ সময়টাতে মন্ত্রী ছিলেন না হাছান মাহমুদ, কিন্তু পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সফলভাবে। রাগ-অভিমানের বদলে তিনি দলের প্রচার সম্পাদক হিসেবে বিরোধী দলকে দিয়েছেন বাকপটুতার দক্ষতায় মোক্ষম সব জবাব।
সাংবাদিকতা ও সাংবাদিক সমাজের অত্যন্ত প্রিয়জন এই হাছান মাহমুদ মুখ খুললেই ‘নিউজ’ হয়ে যেত। সেই নিউজ মানুষ দেখেছে, শুনেছে। বিরোধী দলের অপপ্রচার ও কুৎসার জবাব দিতে তিনি সিদ্ধহস্ত। আলোচনা-সমালোচনায় তাই তাঁকে বছরভর থাকতে হয়েছে সংবাদ শিরোনামে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে হারিয়ে সবাইকে অবাক করে দেন ড. হাছান মাহমুদ। এজন্য প্রথমবার তাক লাগিয়ে দিয়ে মন্ত্রিত্বের মর্যাদা পান তিনি। ২০১৪ সালেও এমপি পদে বিজয়ী হন তিনি। তাঁর নিজের একাডেমিক দক্ষতা পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে।
চট্টগ্রামের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দলের প্রতিকূল সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় বারবার প্রশংসিত হয়েছেন হাছান মাহমুদ। সদ্যসমাপ্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে হ্যাট্রিক বিজয় লাভ করেন তিনি। এবারের নির্বাচনে ২ লাখ ১৭ হাজার ১৫৫ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন তিনি। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী পান মাত্র ৬ হাজার ৬৫ ভোট।
চট্টগ্রামের সন্তান ও সফল এই নেতা একজন তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ায় আমরা খুব খুশি হয়েছি। আরো খুশি হয়েছি, নেত্রীর যুগোপযোগী সিদ্ধান্তে- মিডিয়াবান্ধব একজনকে তথ্যমন্ত্রী করায়। আর গণমাধ্যমের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে আমি সম্মানিত হয়েছি। আশা করছি, প্রধানমন্ত্রীর আস্থার প্রতিদান এবং আমাদের প্রত্যাশার সবটুকু যথাযথভাবে পূরণ করবেন আমাদের নতুন তথ্যমন্ত্রী।
আপনারা অনেকেই জানেন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ুজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় কাজ করে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিলেন ড. হাছান মাহমুদ। রাজনীতি ও ব্যক্তিগত জীবনে সময় দেওয়ার পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতাও করছেন পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ে। ১৯৬৩ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার সুখবিলাস গ্রামে জন্ম নেওয়া ড. হাছান মাহমুদ অনেক বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করে আজকের অবস্থানে উঠে এসেছেন।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল থেকে ১৯৭৮ সালে এসএসসি পাশ করে তৎকালীন ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমানে মহসিন কলেজ) ভর্তি হয়ে ওতপ্রোতভাবে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন আমাদের প্রিয় হাছান ভাই। নির্বাচিত হন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে। এরপর চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে চট্টগ্রামের ছাত্রসমাজকে নেতৃত্ব দেন হাছান মাহমুদ।
তিনি ১৯৯০ সালে চাকসু নির্বাচনের জন্য গঠিত সর্বদলীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হন। রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন কিছুদিন। সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব নেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের। উত্তাল ছাত্ররাজনীতির পাঠ চুকিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য একসময় ইউরোপ চলে যান। ভর্তি হন বিশ্বের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ ব্রিজ ইউনিভার্সিটি ব্রাসেলসে। পাশাপাশি বেলজিয়াম আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। নির্বাচিত হন বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ব্রিজ ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক স্টুডেন্ট ফোরামের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় আসেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এসময় ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
পড়াশোনা শেষে বেলজিয়ামের লিমবার্গ ইউনিভার্সিটি সেন্টাম-এর শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন ড. হাছান মাহমুদ। কিন্তু চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার এই সন্তানকে বিদেশের বিত্ত-বৈভব বেশিদিন আটকে রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়ে বিদেশে শিক্ষকতা ও নিরাপদ জীবনের চাকরি ফেলে দেশে ফিরে আসেন। এসেই জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির (২০০১ সাল) সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর যোগ দেন সভানেত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে। কিছুদিনের মাথায় আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সে দায়িত্ব পালন করেন ড. হাছান মাহমুদ। সভানেত্রীর বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পালন করেন ২০০৮ সাল পর্যন্ত।
আমাদের সদ্য সাবেক তথ্যমন্ত্রী ছিলেন খুবই সংস্কৃতিমনা। কবিতা, গান ও দার্শনিক উক্তিতে ভরপুর ছিল তাঁর বক্তৃতার অলংকার। কিন্তু তাঁর অনেক অসমাপ্ত কাজের গুরুভার এসে পড়েছে বর্তমান মন্ত্রীর কাঁধে। সাংবাদিকদের সর্বশেষ বেতন কাঠামো হয়েছিল ২০১২ সালে; এরপর সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়ার পর সংবাদকর্মীদের দাবির মুখে নবম ওয়েজবোর্ড গঠনের উদ্যোগ নেয় তথ্য মন্ত্রণালয়। কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও নবম ওয়েজবোর্ড গঠন না হওয়ায় আন্দোলনে রয়েছেন সংবাদকর্মীরা।
রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কারণে পাঁচ বছর অন্তর ওয়েজবোর্ড দেওয়া অতীতে সম্ভব হয়নি। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনেক আলোচনার পর ওয়েজবোর্ড দিতে সক্ষম হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৫ বছর পার হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের আগেই নবম ওয়েজবোর্ড গঠন করা হবে বলে সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু আশ্বস্ত করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। হাছান মাহমুদ তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই হবে তাঁর প্রথম কাজ।
আমরা জানি, শেখ হাসিনার সরকার সাংবাদিকবান্ধব সরকার। অসুস্থ, অস্বচ্ছল ও আহত সাংবাদিক এবং নিহত সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের নিয়মিতভাবে ভাতা বা অনুদান দেওয়ার জন্য ২০১৪ সালের পহেলা জুলাই ‘বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট বিল‘ পাস করে বিশ্বে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন তিনি। যার ধারাবাহিকতায় গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নিজ কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টে ২০ কোটি টাকা অনুদান দেন। এই বিশ কোটি টাকা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়।
বর্তমানে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈ-মাসিক ও ষান্মাসিক পত্রিকার সংখ্যা ২ হাজার ৮৩৪টি। এছাড়া তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৩১টি বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলসহ ২৪টি এফএম বেতার ও ৩২টি কমিউনিটি রেডিওর লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি খাতে আছে ৩টি টেলিভিশন চ্যানেল।
এত বিপুলসংখ্যক মিডিয়ার উপস্থিতি প্রমাণ করে বর্তমান সরকার কতটা গণতান্ত্রিক। সরকার গণতান্ত্রিক বলেই বহুমত লালন করছে বলে সবাই বিশ্বাস করে। শুধু কি পরিমাণগত উন্নতি? না। গুণগত মানেও সাংবাদিকতার প্রসারে সরকার বদ্ধপরিকর বলেই জানি। যেমন, তথ্য মন্ত্রণালয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উৎকর্ষের জন্য বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) এবং জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট (এনআইএমসি) প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে। বিগত ৪টি অর্থবছরে ৬২৩ জন সাংবাদিক ও সাংবাদিক পরিবারের মাঝে সর্বমোট ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার অনুদানের চেক বিতরণ করা হয়েছে। জানা গেছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে কর্মরত ২ হাজার ৮৯৭ জন সাংবাদিকের অনুকূলে এক্রিডিটেশন কার্ড ইস্যুসহ ৭ হাজার ৯৪টি এক্রিডিটেশন কার্ড নবায়ন করা হয়েছে।
আরেকবার ফেরা যাক হাছান মাহমুদ প্রসঙ্গে। চট্টগ্রামের এই সন্তান বিখ্যাত হয়েছেন মূলত তাঁর উক্তি ও বচনের জন্য। বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কাজের ধারাবাহিকতা ও বৈশ্বিক প্রচার অব্যাহত রাখতে দরকার হাছান মাহমুদের মতো একজন চৌকশ মানুষ। তথ্যপুত্র হাছান মাহমুদের প্রতি আমাদের আস্থা আছে, আছে ভালোবাসা। বিশ্বাস করি, তিনি নতুন এই যাত্রায় অতীতের মতোই সফল হবেন।
মাননীয় তথ্যমন্ত্রী সমীপে আমার কিছু প্রস্তাব তুলে ধরছি:-
১। অবিলম্বে নতুন ওয়েজবোর্ড প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
২। এক্রিডিটেশন কার্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও প্রকৃত সাংবাদিকদের মূল্যায়ন
৩। সাংবাদিকবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে ও চট্টগ্রামের গণমাধ্যম কর্মীদের কাজের সুবিধার্থে মিডিয়া সেন্টার স্থাপন ও পরিচালনা
৪। দুস্থ ও অসহায় সাংবাদিকদের প্রতি সরকারি সহযোগিতার হাত বাড়ানো
৫। ভুইফোঁড় ও ভুয়া অনলাইন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে প্রকৃত অনলাইন সংবাদসংস্থাকে মূল্যায়ন ও রেজিস্ট্রেশন প্রদান এবং সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন
৬। সাংবাদিক সমাজের সকল দাবির যথাযথ মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন।
লেখক: সম্পাদক, জয়নিউজবিডি