১৯৮০ সালের ৬ এপ্রিল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের বুকে জন্ম নেয় এক রাজনৈতিক দল। যাত্রা শুরুর পর প্রথমবারের মতো লোকসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল তারা। সেই ফলাফলের কারণে কয়েক বছর প্রায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল শীর্ষ নেতৃত্বে।
তারপর প্রবল মানসিক শক্তিতে ঘুরে দাঁড়ায় তারা। মাঝে অনেক সমালোচনার তোপে পড়তে হলেও সেই দল এখন প্রাথমিক সদস্যপদ বিবেচনায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংগঠন। দলটি হলো ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।
২০১৯ সালে বড় জয়ের মাধ্যমে টানা দ্বিতীয়বার দিল্লী জয় করেছে দলটি। এর মধ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট পেয়েছে ৩৫৪ টি আসন। ফের নরেন্দ্র মোদির হাতেই দেশের ভার সপে দিল ভারতীয় জনতা। ভোটগণনায় স্পষ্ট, দ্বিতীয়বারের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠন করছে মোদি-অমিত। ইতোমধ্যে নির্বাচনে হারের পর কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধি মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: ভারতের পাহারাদার মোদি সরকার
দেশের ইতিহাসে মোদিই হতে চলেছেন তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি পর পর দু’বার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী হলেন। অর্থাৎ কোনও জোট বা শরিক দলের সাহায্য ছাড়াই সরকার গঠনের জন্য ম্যাজিক ফিগার ছাড়িয়ে গেল কোনও দল। এর আগে জওহরলাল নেহরু পর পর তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন কংগ্রেসের হয়ে। ১৯৬৭ এবং ১৯৭২ সালে পর পর দু’বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধি। এই দু’বারও একাই ম্যাজিক ফিগার পেরিয়ে গিয়েছিল কংগ্রেস।
ফের দেশজুড়ে গেরুয়া ঝড়। আর সেই ঝড়ে বেসামাল হিন্দি বলয় থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার-ওড়িশা, এমনকি উত্তর-পূর্ব। এককভাবে বিজেপি ২০১৪ সালের ২৮২ আসনকে টপকে গিয়েছে। উল্টোদিকে বিরোধী শিবিরে শুধুই হতাশা। চন্দ্রবাবু নায়ডু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়বতী-অখিলেশরা যে জোট গড়ার চেষ্টায় ছিলেন, নিজেদের রাজ্যেই শোচনীয় ফল তাঁদের। পশ্চিমবঙ্গে এক ধাক্কায় আসন বেড়ে ১৮ হয়েছে বিজেপির। অন্ধ্রে ব্যাপক উত্থান ওয়াইএসআরসিপির।
আনুষ্ঠানিক যাত্রা
আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপি গঠিত হয় ১৯৮০ সালের ৬ এপ্রিল। তবে এ দলের উৎস ১৯৫১ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় জনসংঘ। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার জরুরি অবস্থা জারি করলে জনসংঘ একাধিক রাজনৈতিক দলকে নিয়ে জনতা পার্টি গঠন করে। ১৯৮০ সালে জনতা পার্টি অবলুপ্ত হলে বিজেপি গঠন করেন জনসংঘের নেতারা। প্রতিষ্ঠাকালীন বিজেপির সভাপতির দায়িত্ব পান অটল বিহারী বাজপেয়ী। বৃহৎ জনসমর্থন আদায়ে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তার প্রচারণা চালায় বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন দল।
লোকসভার নেতৃত্ব
১৯৮৪ সালে নিজেদের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে মাত্র দুই আসন পায় বিজেপি। এতে ভেঙে পড়ে নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক মনোবল। তবে দলের আদর্শ একাত্মায় মানবতাবাদ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে কোমর বেঁধে নামেন বিজেপির নেতারা। এর ফলও পায় দলটি। ১৯৮৯ সালের পরবর্তী নির্বাচনে ৮৫ আসন পায় বিজেপি। সমর্থন দেয় জন মোর্চাকে। তাদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারে প্রধানমন্ত্রী হন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং।
আরও পড়ুন: মোদির জয়ের আভাস, বিরোধী শিবিরে হতাশা
১৯৯০ এর দশকে অযোধ্যায় (বিতর্কিত এক স্থানে রামের জন্মভূমি ধরে মন্দির গঠনের দাবিতে) রাম জন্মভূমি আন্দোলন শুরু হলে শক্তি বাড়ে বিজেপির। ওই আন্দোলন প্রশ্নে বিজেপি বিশ্বনাথের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করলে আস্থা ভোটের সম্মুখীন হতে হয় তাকে। শেষে তিনি পদত্যাগ করেন। হিন্দুত্ববাদী ওই আন্দোলনে বিজেপির অবস্থানের কারণে দলটি সেসময় একাধিক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে জয় পায়। ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে পায় ১২০ আসন। এরপর ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে লোকসভায় ১৬১ আসন জিতে পায় বৃহত্তম দলের মর্যাদা। যদিও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে ১৩ দিনের মাথায় ক্ষমতা হারাতে হয় বাজপেয়ীর বিজেপিকে।
১৯৯৮ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচন হলে তাতে জয় পায় বিজেপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট বা এনডিএ। সে জোট সরকার গঠন করে বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে। এ জোট থেকে এআইএডিএমকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে ভেঙে যায় সরকার। ফের ১৯৯৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিজেপি পায় ১৮২ আসন, তাদের এনডিএ জোট পায় ৩০৩ আসন। বাজপেয়ীর নেতৃত্বেই গঠন হয় সরকার। এই সরকার পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করে। এটিই ছিল ভারতে প্রথম পূর্ণ মেয়াদের অ-কংগ্রেস সরকার।
২০০৪ সালের নির্বাচনে ফের হেরে যায় বিজেপি জোট। বাজপেয়ীর দল পায় ১৩৮ আসন। এ নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে কংগ্রেস। এরপর ২০০৯ সালের নির্বাচনে আবারও হেরে বসে এনডিএ জোট। এবার লোকসভায় আসন আরও কমে যায় বিজেপির, পায় ১১৬ আসন।
১০ বছর বিরোধী দলে থাকার পর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় বিজেপির জোট, পায় ৩৩৬ আসন, যেখানে গেরুয়াদের আসনসংখ্যা ২৮২। এ নির্বাচনে জয় পেয়ে বিজেপির গঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন নরেন্দ্র মোদি। গুজরাটের রেলওয়ে স্টেশনের চা বিক্রেতা থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠা এই মোদির নেতৃত্বে এখন দিল্লির মসনদ ছাড়াও বিজেপি দখল করছে রাজ্যগুলোর সরকারের গদিও। শেষ হিসাব মতে ২৯টি রাজ্যের মধ্যে ২০টিরই সরকার চালাচ্ছে গেরুয়া পতাকাধারীরা।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল
২০১৫ সাল পর্যন্ত চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিলো। কিন্তু উইকিপিডিয়ার মতে, ২০১৫ সালের এপ্রিলে বিজেপির প্রাথমিক সদস্যপদই পৌঁছে গেছে ১০ কোটি পর্যন্ত, যা গত তিন বছরে আরও বেড়ে যাওয়ার কথা। আর দলের প্রাথমিক সদস্যপদই যদি ১০ কোটি হয়, তাহলে সমর্থনের দিক থেকে সর্ববৃহৎ দলই হওয়ার কথা বিজেপির।
আরও পড়ুন: সফল শেখ হাসিনার পথে হাঁটছেন মোদি
সদস্যভুক্তিতে ২০১৪ সালে অভিনব প্রচারণা চালু করেন বিজেপির বর্তমান সভাপতি অমিত শাহ। মিসড কল নামে ওই কর্মসূচির আওতায় কেউ মিস কল দিলেই বিনা খরচে বিজেপির সদস্য হয়ে যেতে পারতো, দলের পক্ষ থেকে ফোন করে নিয়ে নেওয়া হতো সদস্যভুক্তির যাবতীয় তথ্য।
অবশ্য বিজেপিপন্থি বিশ্লেষকরা এই সদস্যসংখ্যাকেই দলের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি মানতে চান না। তারা তথ্যপ্রযুক্তিবান্ধব নরেন্দ্র মোদির ঊর্ধ্বমুখী ইতিবাচক প্রভাব ও রাজ্যগুলোতে বিজেপির ক্রমাগত ভালো ফলাফলকে দেখছেন দলের শক্তির পরিচয় হিসেবে।
১৭তম লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল:
বিজেপি- ৩০২
এনডিএ জোট (মোট)- ৩৫৪
কংগ্রেস- ৫০
ইউপিএ জোট (মোট)- ৮৮
অন্যান্য- ৯৯
লেখক: যুগ্ম সম্পাদক ও সিইও, জয়নিউজবিডিডটকম।