বেলা সাড়ে এগারোটা। দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে জাতীয় যুব সংসদীয় উৎসব অনুষ্ঠানে সদ্য বক্তৃতা দিয়ে মঞ্চে এসে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শুরু হয়েছে প্রশ্নোত্তর পর্ব। হঠাৎ মঞ্চে বসা প্রধানমন্ত্রীর হাতে একটি চিরকুট গুঁজে দিলেন এক পদস্থ আমলা। তাতে চোখ বুলিয়ে দর্শকদের নমস্কার করে মুহূর্তের মধ্যে বেরিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী।
এর কয়েক মিনিট পরেই খবর আসতে শুরু করল, কাশ্মীরের পুঞ্চ ও রজৌরি সেক্টরে হামলা চালিয়েছে পাক বায়ুসেনা। জবাব দিয়েছে ভারতও।
বিজ্ঞান ভবন থেকে বেরিয়ে সেনাপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী। পরে বিদেশ মন্ত্রক জানায়, আজ সকালে নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে পাক বিমানকে চিহ্নিত করে ভারতীয় রেডার। হামলার আশঙ্কায় প্রস্তুত ছিল ভারতীয় বায়ুসেনা। জবাব দিতে মুহূর্তে আকাশে ওড়ে ভারতের যুদ্ধবিমান। শুরু হয় লড়াই। নয়াদিল্লির দাবি, পাকিস্তানের একটি বিমানকে (এফ-১৬) গুলি করে নামিয়েছে ভারতের মিগ-২১ (বাইসন)। পাক বিমানের চালককেও প্যারাশুটে করে নামতে দেখা গেছে বলে দাবি সাউথ ব্লকের।
ভারতের সেই দাবিকে খারিজ করে দিয়ে পাক সেনার মুখপাত্র আসিফ গফুর দাবি করেন, আজ তারা কোনও এফ-১৬ বিমান ব্যবহারই করেননি। উল্টে তিনি জানান, ভারতের একটি মিগ-২১ বিমান ধ্বংস হয়েছে। সে কথা স্বীকার করেছে দিল্লি। তবে এ দিনের হানার লক্ষ্য অসামরিক জায়গা ছিল বলে যে দাবি পাকিস্তান করেছে, তা খারিজ করে দিল্লির দাবি, সামরিক ঘাঁটিই আক্রমণ করতে চেয়েছিল পাক বিমান। যা বানচাল করা হয়েছে।
পাকিস্তান প্রথমে জানিয়েছিল, ভারতের দুটি বিমান গুলি করে নামিয়েছে তারা এবং দুই চালক তাদের হাতে ধরা পড়েছেন। তাঁদের একজন হাসপাতালে ভর্তি। অন্যজন সুস্থ। পরে অবশ্য বিবৃতি পাল্টে এক জনকে গ্রেফতার করার কথাই বলা হয়।
গ্রেফতার হওয়া পাইলট উইং কম্যান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের তিনটি ভিডিয়ো সামনে এনেছে পাক সেনা। প্রথমটিতে জঙ্গলে ঘেরা একটি নালার মধ্যে পড়ে থাকতে দেখা যায় ওই অফিসারকে। তাঁকে স্থানীয়দের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান পাক সেনারা। দ্বিতীয় ভিডিয়োটিতে চোখ বাঁধা অবস্থায় রক্তাক্ত অভিনন্দনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা যায়। জিজ্ঞাসাবাদে অভিনন্দন নিজের নাম ও সার্ভিস নম্বর জানান। পাশাপাশি জানতে চান, তিনি কি পাক সেনার হেফাজতে রয়েছেন? যদিও সেই উত্তর তাঁকে দেওয়া হয়নি।
চোখ বাঁধা রক্তাক্ত অভিনন্দনকে দেখার পরেই ভারতজুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদের ঝড়। অবিলম্বে ওই অফিসারকে ভারতে ফেরানোর দাবিতে সরব হন নেটিজেনরা। রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়ে সরকার। আজ দিল্লিতে বিরোধী দলের বৈঠকেও বায়ুসেনার ওই অফিসারকে দ্রুত ভারতে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান বিরোধী নেতারা। অভিনন্দনের বাবা বায়ুসেনার প্রাক্তন এয়ার মার্শাল এস বর্তমান ছেলের রক্তাক্ত চেহারা টেলিভিশনে না-দেখানোর আবেদন করেন।
এদিকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে অভিনন্দনকে দ্রুত ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সব ধরনের চেষ্টার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে বিকেলে দিল্লিতে নিযুক্ত পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সইদ হায়দর শাহকে ডেকে পাঠান বিদেশসচিব বিজয় গোখলে।
পুলওয়ামার ঘটনায় জইশ-ই মহম্মদ জঙ্গিদের যোগাযোগের তথ্যপ্রমাণ-সহ একটি ডসিয়ের শাহের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
একইসঙ্গে শাহের কাছে অভিনন্দনের সুস্থ শরীরে দ্রুত মুক্তি দাবি করেছে ভারত।
গোটা মুখে রক্ত, হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, কলার ধরে টানতে টানতে ওই বায়ুসেনার অফিসারকে নিয়ে যাওয়ার ছবি তুলে তা ছড়ানোয় ভারত যে ক্ষুব্ধ তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে শাহকে। এটা যে মানবিকতা ও জেনিভা কনভেনশনের বিরোধী সে কথাও জানানো হয় তাঁকে। অভিনন্দনকে যে পাকিস্তান গ্রেফতার করেছে তা কেন সরকারিভাবে ভারতকে জানানো হয়নি তা নিয়েও শাহকে প্রশ্ন করা হয়। প্রাক্তন সেনা কর্তাদের মতে, অভিনন্দনকে যুদ্ধবন্দির মর্যাদা দেওয়া উচিত। কারণ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কেউ ধরা পড়লে জেনিভা কনভেনশন অনুযায়ী তাঁকে যুদ্ধবন্দির মর্যাদা দিয়ে তাঁর অধিকার সুনিশ্চিত করতে হয়।
এর পরেই অভিনন্দনের তৃতীয় একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করে পাক সেনা। তাতে দেখা যায় তিনি চা খাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে পাক সেনা অফিসারেরা যে ভালো ব্যবহার করেছেন তা-ও বলতে দেখা যায় অভিনন্দনকে। এতে সাময়িক স্বস্তি পেলেও, আপাতত অভিনন্দনের মুক্তিই পাখির চোখ করেছে দিল্লি।
রাতে নিজের বাসভবনে সেনাপ্রধানদের সঙ্গে ফের বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে গোটা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী সেনাপ্রধানদের বলেছেন, কোনো চাপেই ভারত মাথা নত করবে না। পাকিস্তানকে ‘জবাব’ দেওয়ার ব্যাপারে সেনাপ্রধানদের যে ‘স্বাধীনতা’ দেওয়া হচ্ছে, সে কথাও তাঁদের এ দিন ফের জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
সূত্র: আনন্দবাজার