‘সন্তান জন্ম দেয়া অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যিনি মা হয়েছেন একমাত্র তিনিই বোঝেন এর মর্মব্যথা। কাউকে বলে বুঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু এর চেয়েও যে বেশি কষ্টের কোনো ব্যাপার থাকতে পারে তা জানা ছিল না। সেটি জানলাম, যখন আমার দুই বছর চার মাস বয়সী একমাত্র শিশুকন্যা রাফিদা খান রাইফা চট্টগ্রাম নগরের ম্যাক্স হাসপাতালের গাফেলতি, চিকিৎসকদের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার কারণে অকালে মৃত্যুবরণ করল তখন। কোলের সন্তান হারানোর শোক যে কত কষ্টের তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। সন্তান হারানোর শোক সহ্য করার মতো নয়। এই অসহনীয় শোক আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে সারাটা জীবন। সন্তান হারানোর এই অসহ্য শোকের পাশাপাশি আরো একটি কষ্ট নিয়েই হয়তো কাটাতে হবে জীবনের বাকিটা সময়। আর সেটি হলো, যাদের কারণে আমি মেয়ে হারালাম, সেই অভিযুক্ত চিকিৎসকদের হয়তো বিচারও হবে না! তারা চিকিৎসক। তারা অনেক প্রভাবশালী। তারা যেন আইনেরই ঊর্ধ্বে! তাই মেয়ে হারানোর কষ্টের পাশাপাশি বিচার না পাওয়ারও মনোবেদনা পেয়ে বসেছে আমাকে।’
বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষে এভাবেই শোকাহত রাইফার মা রুমানা খান সাংবাদিকদের কাছে তার কষ্টের কথা তুলে ধরেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ঠাণ্ডাজনিত সামান্য গলা ব্যথা নিয়ে চট্টগ্রাম নগরের বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল শিশুকন্যা রাইফা। তার এই সাধারণ রোগ প্রাণঘাতী ছিল না। তারপরও ওই হাসপাতালে ভর্তির মাত্র দুইদিনের মাথায় কেন না ফেরার দেশে চলে গেল আমার মেয়ে? এটা যে চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসা আর অবহেলার কারণে হয়েছে তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
তিনি অভিযোগ করেন, আমার মেয়ে মারা যাওয়ার পর যখন সারাদেশের বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, তখন বিবেকবান কয়েকজন চিকিৎসকও আমাদের জানিয়েছেন, ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের অবহেলার কারণেই মৃত্যু হয়েছে শিশুকন্যা রাইফার। রফিসিন নামের যে এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়েছিল শিশু রাইফার শরীরে, সেটি ওভারডোজ দেওয়ার কারণে রিঅ্যাকশন হয়েছিল বলে বিবেকবান চিকিৎসকরাই জানিয়েছেন আমাদের।
ওই চিকিৎসকদের অভিমত, এন্টিবায়োটিকের রিঅ্যাকশনের কারণেই শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে রাইফা। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি রাইফার মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকদের অবহেলার প্রমাণ পেয়েছে। ওই তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে অবহেলার দায়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশও করা হয়েছে। এরপরও চট্টগ্রামের বিএমএ নেতারা ও ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বাঁচানোর জন্য নানামুখী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ক্ষমতা ও টাকার জোরে সবকিছু নিজেদের পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের এই অপতৎপরতার কারণে এখন মনে হচ্ছে, মেয়ে হারালাম, এখন হয়তো বিচারও পাব না।
চিকিৎসায় অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু প্রতিরোধ, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এবং চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের স্বার্থে রাইফার মৃত্যুর ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত চার্জশিট প্রদানের দাবি জানান রুমানা খান। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।
গত বছরের ২৯ জুন রাতে চট্টগ্রামের বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান শিশু রাইফা। গত ১৮ জুলাই ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার অভিযোগ এনে ৪ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে থানায় এজাহার দায়ের করেন রাইফার বাবা সাংবাদিক রুবেল খান। এজাহার দায়েরের দুইদিন পর এজাহারটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। চকবাজার থানায় দায়ের করা মামলায় ডা. বিধান রায় চৌধুরী, ডা. দেবাশীষ সেনগুপ্ত, ডা. শুভ্র দেব ও বেসরকারি ম্যাক্স হাসাপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী খানকে আসামি করা হয়।
বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছেন চকবাজার থানার ওসি (তদন্ত) রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী। তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান তিনি।
জয়নিউজ/পলাশ/আরসি