বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর প্রায় দুই বছর পর অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এলো।
মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। ঈদের ছুটির আগে ৭ জুলাই আকুর মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়েছিল। ছুটির পর প্রথম কর্মদিবসে সমন্বয়ের পর রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
আমদানি বাড়ায় বাজারের চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। দুই-একদিনের মধ্যেই রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে উঠবে বলে আশা করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। এরপর থেকে রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে গত বছরের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।
এর পর আমদানি বাড়তে থাকায় এই রিজার্ভ কমতে শুরু করে। এক বছর আগে ৬ জুলাই রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ দিন ৩০ জুন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। ঈদের ছুটির আগে ৭ জুলাই ছিল ৪২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।
ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ঢল নামার পরও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে এই সূচক ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
বাজারে ডলারের চাহিদা মেটাতে ঈদের ছুটির আগে রিজার্ভ থেকে ৩৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। ছুটির পর প্রথম কর্মদিবস মঙ্গলবার বিক্রি করা হয়েছে ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সবমিলিয়ে নতুন অর্থবছরে (২০২২-২৩) ৪৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি ১০ লাখ (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো তুলে নেয়া হয়েছে। তার ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করলে আকুর বিল পরিশোধের পরও রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে অবস্থান করত বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি বিভাগের এক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ঈদের আগে প্রবাসীরা যেভাবে বেশি বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল, আকুর দেনা শোধের পরও রিজার্ভ ৪০ বিলিয়নের উপর থাকবে। কিন্তু রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে সেটা আর সম্ভব হলো না। সামান্য কম আছে, দুই-একদিনের মধ্যেই ৪০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে।’
ঈদের ছুটির আগে সাত দিনেই ৯০ কোটি ৯৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারের বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা) টাকার অঙ্কে সাত দিনের এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। গড় হিসাবে প্রতিদিন এসেছে ১ হাজার ২১৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক সপ্তাহে এত রেমিট্যান্স দেশে আসেনি।
বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যাংকগুলো আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারের দরের চেয়েও বেশি দামে রেমিট্যান্স দেশে আনছে। কোনো কোনো ব্যাংক ৯৫/৯৬ টাকায় প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স দেশে আনছে।
এ হিসাবে টাকার অঙ্কে এই সাত দিনে রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরও বেশি বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
রেমিট্যান্সপ্রবাহে নিম্নমুখী ধারায় শেষ হয় ২০২১-২২ অর্থবছর। ৩০ জুন শেষ হওয়া এই অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম।
২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
১০ জুলাই দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়। সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে কোরবানির পশুসহ প্রয়োজনীয় অন্য কেনাকাটা করতে অন্যান্যবারের মতো এবারও পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। সে কারণেই রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘এই সময়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির খুবই দরকার ছিল। নানা পদক্ষেপের কারণে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে আশা করছি এখন মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।’
ঈদের ছুটির আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ছয় দিনের (১ থেকে ৬ জুলাই) রেমিট্যান্সের তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তাতে দেখা যায়, নতুন অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম মাস জুলাইয়ের প্রথম ছয় দিনে ৭৪ কোটি ১০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর মধ্যে প্রথম পাঁচ দিনে (১ থেকে ৫ জুলাই) এসেছিল ৫৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ৬ জুলাই এসেছিল ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
ঈদের ছুটির পর মঙ্গলবার চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের রেমিট্যান্সের তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যাচ্ছে, ১ থেকে ৭ জুলাই মোট ৯০ কোটি ৯৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এ হিসাবে ঈদের ছুটির আগে শেষ কর্মদিবস ৭ জুলাই এসেছিল ১৬ কোটি ৮৩ লাখ ডলার।
এর আগে কোনো ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে এমন উল্লম্ফন দেখা যায়নি।
আমদানি ব্যয় বাড়ায় গত ৯ মে আকুর মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের রেকর্ড ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এরপর সপ্তাহ খানেক রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের নিচে অবস্থান করে।
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় কয়েক দিন পর অবশ্য তা ৪২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। বাজারে ডলারের সংকট দেখা দেয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর ডলার বিক্রি করায় সেই রিজার্ভ ফের ৪২ ডলারের নিচে নেমে আসে; একপর্যায়ে তা ৪১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল।
এর আগের মেয়াদে অর্থাৎ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদে আকুর ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল শোধ করা হয়েছিল।
ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল- প্রতি মাসে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে দেশে। মে মাসে অবশ্য আমদানি ব্যয় কমে ৬ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
এ হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। তখন ওই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। তখন অবশ্য প্রতি মাসে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হতো।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
জেএন/এমআর