আকস্মিক বন্যায় জলে ভেসে গেছে সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার চার শতাধিক পুকুর। সে সাথে ভেসে গেছে মাছচাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার অনেকের স্বপ্ন।
দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ ও নিজের কষ্টের সঞ্চয় বিনিয়োগ করে মাছের খামার গড়ে তোলা অনেক মাছচাষিরা। তেমনি একজন মাছ চাষীর নাম লেইচ নূর মিয়া।
তিনি সুনামগঞ্জ পৌর শহরের উত্তর আরপিননগর এলাকার বাসিন্দা। স্বপ্ন দেখেছিলেন মাছ চাষ করে লাভবান হবেন। সেই স্বপ্ন সত্যি করতে ঝণ করে টাকা নিয়ে তিনটি পুকুরের মাধ্যমে শুরু করে ছিলেন মাছ চাষ।
কিন্তু হটাৎ যেন সেই স্বপ্ন নিমিষেই দুলিসাৎ হয়ে গেলে। সম্প্রতি উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়। আর সেই বন্যার বানের পানিতে ভেসে যায় পুকুরের সকল মাছ। স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে এখন নিশ্বঃ হয়ে দিশেহারা হয়ে গেছেন লেইচ নুর মিয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কুরবান নগর ইউনিয়নে মনরপুর গ্রামে ২টি পুকুরে ৪০ লক্ষ টাকার মাছ ও সুনামগঞ্জ পৌর শহরের পশ্চিম হাজীপাড়া ১টি পুকুরে ৫ লক্ষ টাকার রুই, কাতলা, কারফু, গাসকাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনে চাষ করছিলেন লেইচ নূর মিয়া।
এই মাছ গুলো বড় হয়ে বিক্রি করলে সকল ঋণ সুদ করে তিনি লাভবান হতেন। কিন্তু বানের পানি তার সকল স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
শুধু তাই নয় ২০২০ সালের বন্যায় লেইচ নুর মিয়ার আরোও তিনটি পুকুর থেকে ৩০ লক্ষ টাকার মাছ ভেসে যায়। যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ২০২২ সালে বড় করে তিনটি পুকুরে তিনি ঋণ করে মাছ চাষ শুরু করেছিলেন।
ক্ষতিগ্রস্থ লেইচ নূর মিয়া জানান, আমি একবারে নিশ্বস হয়ে গেলাম। অনেক আশা নিয়ে তিনটি পুকুরে ৪৫ লক্ষ টাকার মাছ চাষ করেছিলাম ভেবেছিলাম মাছ গুলো বড় করে বিক্রি করতে পারলে অনেক লাভবান হবো কিন্তু বানের পানি আমার সব মাছ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এখন আমি এত মানুষের ঋণ কিভাবে সুদ করব সেই চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছি।
শুধু নুর মিয়াই নই। সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার প্রায় সব মাছচাষি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেকের ব্যাংকঋণ রয়েছে।
দেনা আছে মাছের খাবারের দোকানেও। সরকারি ঋণ বা প্রণোদনা না পেলে এসব চাষি যে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না সে কথা বলছেন খোদ মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারাও।
নূর মিয়ার আরেক সহযোগী ব্যবসায়ী পাঠনার সোহেল মিয়া জানান, আমরা একসাথে ১০ একর পুকুরে ৪৫ লাখ টাকার মাছ চাষ করেছিলাম। বানের পানিতে সব মাছ ভেসে গেছে। এখন চিন্তায় আছি কয়েকটি দোকান থেকে মাছের খাদ্য বাকি এনে ছিলাম। তা কিভাবে পরিশোধ করব তা নিয়ে চিন্তিত আমরা।
পশ্চিম হাজী পাড়া পুকুরে দায়িত্বে থাকা আব্দুস শহীদ জানান, বানের পানি যখন পুকুরে এসে পড়ছে তখন পানি আটকানোর অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। পানি গতি এতটা ভয়াবহ ছিল যে পুকুরের পার ভেঙে সকল মাছ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পরে কোন রকম জানটা নিয়ে সেখান থেকে বেঁচে ফিরেছি।
সুনামগঞ্জ জেলা মৎ্য কর্মকর্তা সুনীল মন্ডল জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মৎস্য চাষীদের তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তারা যাতে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে সরকার সেই ব্যবস্থা করবে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ১২টি উপজেলায় ২৫ হাজার ১৭৩টি পুকুর রয়েছে। এর মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীন ২০টি ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৫৩টি। বাকি ২৫ হাজার পুকুরে ব্যক্তিমালিকানায় মাছ চাষ করা হয়। জেলায় মাছচাষি আছেন ১৬ হাজার ৫০০ জন।
এবারের বন্যায় সব পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া মাছের পরিমাণ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। পোনা ভেসে গেছে প্রায় ১০ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে অবকাঠামোর প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জেএন/পিআর