প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেবল রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর না করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য রপ্তানির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল নয়, রপ্তানী নির্ভর বিদেশি মুদ্রা অর্জনের দিকে আমাদের আরো বেশি মনযোগ দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী পণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দেশের রপ্তানী বাস্কেটকে আরো সমৃদ্ধ করতে এবং বিদেশে নতুন বাজার খুঁজে বের করতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেন্টেনিয়াল কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ সহ দেশের বিভিন্ন উপজেলায় নির্মিত ২৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
তিনি গণভবন থেকে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের পণ্য যাতে বিদেশে রপ্তানী হয় সেজন্য পণ্যের বহুমুখীকরণ করা এবং পণ্যের জন্য নতুন নতুন বাজার আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। যেখানে যে পণ্যের চাহিদা সেই ধরনের পণ্য বাংলাদেশে উৎপাদনের মাধ্যমে রপ্তানী করেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পদক্ষেপ আমরা নেব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের একটা কথা সবসময় মাথায় রাখতে হবে, পরনির্ভরশীলতা আমাদের কমাতে হবে এবং নিজেদের পায়ে নিজেরা যেন দাঁড়াতে পারি সে ব্যবস্থাটাই করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিষয়ে নানা রকম মন্তব্য ও গুজবের বিষয়েও কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এটা একটু কম-বেশি হবেই। কিন্তু আমাদের নানা লোকজন রয়েছে যারা এটা নিয়ে নানারকম মন্তব্য এবং গুজব করে বেড়ায়।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আমাদের ৩ মাসের খাদ্য কেনার যে রিজার্ভ সেটা থাকলেই যথেষ্ট। তবে ভোগ্যপণ্য এবং খাদ্যপণ্যে পরনির্ভরশীলতা কমাতে হবে, নিজের দেশে উৎপাদন বাড়াতে হবে।’
সরকার প্রধান বলেন, আমাদের যে উর্বর জমি ও জনসংখ্যা রয়েছে তাতে উদ্যোগ নিলে আমরা সেটা করতে পারি। শুধু উৎপাদন নয় খাদ্যপণ্য সংরক্ষণ আধুনিকীকরণ করতে হবে এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পও ব্যাপকভাবে গড়ে তুলতে হবে। এতে করে দেশের মানুষের জন্য যেমন একটা বাজার তৈরী হবে আবার বিদেশেও আমরা রপ্তানী করতে পারবো।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে করোনা ভাইরাস মোকাবেলা করতে হয়েছে আমাদের, তারই সাথে শুরু হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধ অর্থহীন। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এই যুদ্ধ শুধুমাত্র যারা অস্ত্র তৈরি করে তারাই লাভবান হচ্ছে, আর সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই যুদ্ধ, শুধু যুদ্ধই না তার সাথে আবার স্যাংশন। এই স্যাংশন, পাল্টা পাল্টি স্যাংশনের ফলে আজকে সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।’
তিনি আরো বলেন, উন্নত দেশগুলো হিমসিম খাচ্ছে এবং তারা এখন বিদ্যুৎ সাশ্রয়, জ্বালানি সাশ্রয়, খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত এবং সেকারণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
তিনি বলেন, সেখানে আমাদের মতো দেশ, কেবল আমরা উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করেছি। আমরা একটা লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আপ্রাণভাবে, আর তখনই এই ধরনের বাঁধা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।
আমাদেরকে থেমে থাকলে চলবে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে জ্বালানি সাশ্রয়ের ব্যাপারে সকল দেশই কিন্তু নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমরাও সেটা অনুসরণ করছি।
তিনি বলেন, আমাদের দরকার হচ্ছে একটা দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। কেননা আমাদের যুব সমাজ রয়েছে। এই ক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে এবং আমরা তা নিচ্ছি।
বিদেশে দক্ষ কর্মী প্রেরণে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আরো স্কিল সংযোজনের পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যানবাহন চালক হিসেবে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে তার সঙ্গে ভারি যানবাহন চালনার বিষয়টিও যুক্ত করতে হবে। এতে করে আরো ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে বলেও আমি মনে করি। তিনি গৃহকর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে বিদেশ গমনেচ্ছুরা যেন সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তা নিশ্চিত করার জন্যও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বিদেশে কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে সকল মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাসপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শ্রম বাজার খুঁজবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় সার্টিফিকেট দেবে আর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় মানুষ প্রেরণ করবে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়কে যৌথ ও মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। এসব কাজের জন্য প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয় থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিয়ে একটি কমিটি করে স্ব উদ্যোগে কাজ করারও পরামর্শ দেন তিনি। তাহলে সব কাজগুলো এক জায়গায় বসে সহজেই করা সম্ভব হবে। তিনি এর সঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়কেও সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন।
সরকার প্রধান এ সময় দালালের খপ্পরে পড়ে সোনার হরিণ ধরতে ভিটে-মাটি বিক্রি করে কেউ যেন আর প্রবাসের পথে পাড়ি না জমান সে জন্য যুব সমাজকে সতর্ক করেন। কারণ, এভাবে গেলে তারা বিপদে পড়ে এবং সরকারের পক্ষ থেকেই তাদের উদ্ধার করতে হয় অথবা ভুমধ্যসাগরে তাদের সলিল সমাধি হয় (অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে অভিবাসন খুঁজতে গিয়ে)। এটা দুর্ভাগ্যজনক। প্রয়োজনে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তিনি বিদেশে যাবার আহবান জানিয়ে বলেন, এখানে বিনা জামানতেও ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা রয়েছে।
তাঁর সরকার যে টিটিসি করে দিচ্ছে এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরো দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে বিদেশ গমনেচ্ছুরা যেন যথাযথ প্রশিক্ষণ নেয় তা নিশ্চিত করারও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে ৪০টি টিটিসি ও ১টি আইএমটি স্থাপিত হলে মোট ১০৪টি টিটিসি এবং ৭টি আইএমটিতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হবে এবং মোট প্রশিক্ষণ প্রদানের সক্ষমতা বছরে ৯ লাখে উন্নীত হবে। তাছাড়া সরকারের প্রায় ২৩টি মন্ত্রণালয় থেকেই কোন না কোনভাবে জনশক্তি প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান। তাছাড়া সশস্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা যে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে তারাও রেমিট্রান্স পাঠাচ্ছে। এটাকেও মূল রেমিট্যন্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।
তাঁর সরকার সবসময় বিদেশগামী কর্মীদের স্বার্থ সুরক্ষায় বিশেষ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৩ বছরে ৫৫টি নতুন শ্রম বাজার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে হয়রানিসহ নানা অভিযোগে অনেক জায়গাতেই শ্রম বাজার কমে আসে। সে সময়কার সিন্ডিকেটের দুর্নীতি ও হয়রানি বন্ধ করে তাঁর সরকার বিদেশগামী শ্রমিকদের হয়রানি অনেকটাই লাঘবে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০০৫-০৬ সালে জোট সরকারের বিদেশে কর্মী প্রেরণের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৫২ হাজার ৭০২ জন, আর রেমিট্যান্সের পরিমান ছিল ৪ দশমিক ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেখানে আওয়ামী লীগ সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ৫ গুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এই সময়ে কর্মী প্রেরণ করা হয়েছে ৯ লাখ ৬৬ হাজার ৫০৫ জন এবং ২১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী এই পরিসংখ্যান তুলে সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বলেন, যারা এখন সমালোচনা করেন তাদেরকেই জবাবটা দিতে চাই কারণ, তাহলে আর বিভ্রান্তি ছড়াতে পারবেনা, তাদেরও হিসেবটা জানা উচিত তারা ক্ষমতায় থাকতে কি অবস্থা ছিল দেশে।
জেএন/কেকে