অপরাধ জগতে আবুল কাশেম আলমগীরের আবির্ভাব অনেক আগেই। কখনো তার বিরুদ্ধে উঠেছে নারী নির্যাতনের অভিযোগ। কখনো গ্রেফতার হয়েছেন তিনি তিন কেজি গাঁজাসহ। আবার মানুষের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া, লুট প্রভৃতি গুরুতর অপরাধেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শুধু আলমগীর নয়, তার স্ত্রী রুবি বেগমের বিরুদ্ধেও রয়েছে অস্ত্র ও পুলিশের উপর হামলার দুটি মামলা। আলমগীরের শ্যালক নূরে আলম এবং জানে আলমও বড় অপরাধী। বড় ভাই নূরে আলমের বিরুদ্ধে আছে ষোলটি মামলা, তার ছোটভাই জানে আলম আসামি আট মামলার।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা পুলিশের খাতায় তাদের অপরাধের ফিরিস্তি লম্বা। নূরে আলমের নাম আকবর শাহ থানার তালিকায় এক নম্বরে। তিন নম্বরে আছেন জানে আলম। জানে আলম ও নূরে আলমের পিতা মরহুম ধনু মিয়া ভাণ্ডারী এবং মা আনোয়ারার বিরুদ্ধেও রয়েছে মামলা। স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র, শালা-দুলাভাই মিলে চট্টগ্রামে গড়ে তুলেছে মাদক ও অস্ত্রের কারবার। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন এসব তথ্য।
এত অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, তারা এবার মাঠে নেমেছে পুলিশকে ‘চাপে’ রাখতে। ২৮ সেপ্টেম্বর ফিরোজ শাহ কলোনির এক নম্বর ঝিল এলাকা থেকে একটি এলজি ও দুই রাউন্ড গুলিসহ আলমগীকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনার ২০ দিন পর ১৮ অক্টোবর আলমগীরের স্ত্রী রুবি বেগম এ মামলাকে ‘মিথ্যা’ অ্যাখ্যা দিয়ে আকবরশাহ থানার ওসি জসিম উদ্দিনসহ ছয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে দুই লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন চট্টগ্রাম মহানগর বিশেষ জজ আদালতে। এ অভিযোগে অন্য বিবাদিরা হলেন এসআই আলাউদ্দিন, আশহাদুল ইসলাম, এএসআই সাইফুল ইসলাম, আবু বক্কর সিদ্দিক, কনস্টেবল নুরুল আলম।
অভিযোগে আকবর শাহ থানার ওসি জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবির কথা বলা হয়। চাঁদা না পেয়ে আলমগীরকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসানো হয়েছে বলে আদালতে দায়েরকৃত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে আকবরশাহ থানার ওসি জসিম উদ্দিন জয়নিউজকে বলেন, রুবি বেগম নিজে দুই মামলার আসামি। এসব মামলায় সে পলাতক। তার ভাই নূরে আলম ১৬ মামলার আসামি। তাকে পুলিশ-র্যাবসহ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হন্যে হয়ে খুঁজছে।
ওসি বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগে রুবি বেগম বলেছেন, নুরুর কাছে আমি ২ লাখ টাকা দাবি করেছি। ১৬ মামলার আসামি আমার সামনে আসার সাহস পাবে কোত্থেকে? থানায় সিসি টিভি ক্যামেরা আছে। এসব ক্যামেরা দিয়ে সিএমপি থেকে মনিটরিং করা হয়। নূরুকে গ্রেফতারের জন্য আকবরশাহ থানা পুলিশ একাধিকবার অভিযান চালিয়েছে। র্যাবও অভিযান চালিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার আবুল কাশেম আলমগীরের বিরুদ্ধে মানুষের ঘরবাড়িতে হামলা, লুটপাট, নারীদের শ্লীলতাহানি, জমিদখল, মাদক পাচারসহ বিভিন্ন ঘটনায় ৪টি মামলা আছে।
মাদক ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের অভিযান চলছে। এ অভিযানকে প্রশ্নবিদ্ধ ও পুলিশের মনোবল দুর্বল করতে সন্ত্রাসীরা আদালতে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে বলে দাবি ওসি জসিমের।
এদিকে আকবরশাহ থানার প্রাক্তন ওসি (বর্তমান পাহাড়তলী থানার ওসি) সদীপ কুমার দাশ জয়নিউজকে বলেন, আলমগীর, তার শালা নূরে আলম ও জানে আলম দীর্ঘদিন ধরে মাদক ও অস্ত্রসহ নানা অপরাধের সাথে জড়িত। ২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল আলমগীর তিন কেজি গাঁজাসহ পাহাড়তলী থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়।
আকবরশাহ থানার ওসি জসিম উদ্দিন জানান, ২০০৯ সালের ১০ জুন নারী নির্যাতন, হামলা, ঘরবাড়ি লুটপাটের অভিযোগে লক্ষ্মীপুর সদর থানায় তার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা দায়ের হয়। ২০১৬ সালের ১৩ জুন ঘরে অগ্নিসংযোগের মামলা দায়ের হয় আকবরশাহ থানায়। এ মামলায় তার শ্যালক জানে আলম এক নম্বর, নূরে আলম নূরু দুই নম্বর ও সে তিন নম্বর আসামি। এছাড়া তার শ্যালক নূরে আলম নূরুর বিরুদ্ধে ষোলটি মামলা রয়েছে। নূরে আলম নগরের অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী এবং ছিনতাইকারী। অপর শ্যালক জানে আলমের বিরুদ্ধে রয়েছে ৮টি মামলা।
এ ব্যাপারে ওসি জসিম উদ্দিন জয়নিউজকে জানান, খুলশী থানায় ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে গোলযোগ সৃষ্টি অপরাধের মামলা দিয়ে শুরু। তারপর একই থানায় ১৬ অক্টোবর ২০১২ সালে অস্ত্র আইনে মামলা। সর্বশেষ ১৪ অক্টোবর ২০১৮ সালে আকবরশাহ থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলাসহ মোট ১৬টি মামলা রয়েছে। তার ছোট ভাই জানে আলমের বিরুদ্ধে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নগরের বিভিন্ন থানায় হামলা, ভাংচুর, ছিনতাই, মাদক পাচার, অবৈধ অস্ত্র বহনসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের হওয়া ৮টি মামলা রয়েছে। তার বোন ও আলমগীরের স্ত্রী রুবি বেগমের বিরুদ্ধে পুলিশের উপর হামলা ও অস্ত্র আইনে দায়ের হওয়া দুটি মামলা রয়েছে।
তিনি আরো জানান, রুবি, নূরে আলম ও জানে আলমের পিতা ধনু মিয়া ভাণ্ডারী এবং মা আনোয়ারার বিরুদ্ধেও মামলা রয়েছে। তারা মূলতঃ অস্ত্র ও মাদকের কারবারি।
তিনি আরো জানান, কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম এসে নগরের ফিরোজশাহ কলোনি এলাকায় বসতি গড়ে তারা। এরপর থেকে নূরুর পরিবার গড়ে তুলেছে অপরাধের সাম্রাজ্য। তারা আত্মীয়তা করে নারী নির্যাতন, জমিদখল, লুট, মাদক মামলার আসামি আবুল কাশেম আলমগীরের সাথে। তাদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ওসি জসিমসহ আকবরশাহ থানা পুলিশের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে দায়ের করা অভিযোগে রুবি বেগম উল্লেখ করেন, ফিরোজশাহ কলোনি এলাকায় ইব্রাহিম নামে এক যুবক বিদ্যুৎস্পর্শে মারা যায়। দুই লাখ টাকা চাঁদা না দিলে ওই ঘটনায় মামলা দায়ের করে আলমগীরকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেন আসামিরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি জসিম উদ্দিন বলেন, ইব্রাহিম যে এলাকায় মারা যায় সে এলাকায় গিয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে কোনো বৈদ্যুতিক খুঁটি পায়নি।
তিনি বলেন, স্থানীয়রা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন ২৬ সেপ্টেম্বর পাহাড় কাটতে গিয়ে ইব্রাহিম মারা যায়। আর পাহাড় কাটার তদারকি করছিলেন নূরে আলম, আলমগীর, জানে আলমসহ চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। নূরে আলম ইব্রাহিমের পরিবারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলা করা থেকে বিরত রেখেছে। তবে ইব্রাহিমের পরিবার মামলা করতে পারে।
তিনি বলেন, পাহাড় কাটার ঘটনায় ২ জনকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেছে পুলিশ। জব্দ করেছে পাহাড় কাটার সরঞ্জামও। পাহাড় কাটার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় পলাতক রয়েছে একাধিক আসামি।
এ ব্যাপারে আলমগীরের স্ত্রী রুবি বেগমের আইনজীবী এডভোকেট ফখরুল ইসলাম জয়নিউজকে বলেন, যে কারো বিরুদ্ধেই মামলা থাকতে পারে। তারা যদি অপরাধী হয় আদলতে বিচার হবে। অপরাধী না হলে মামলা থেকে খালাস পাবে। আলমগীরকে যে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে তাতে অনেকগুলো অসঙ্গতি রয়েছে। আমরা সেগুলো আদালতে তুলে ধরেছি। আদালত চাইলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারেন।
জয়নিউজ/আরসি