আদালত অবমাননার মামলায় কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) সতর্ক করে হাইকোর্ট বলেছেন, যেকোনো মানুষ যাতে আপনার কাছে অভিযোগ নিয়ে যেতে পারে সে জন্য দরজা-জানালায় কোনো ভারী পর্দা রাখবেন না। সাধারণ মানুষের জন্য আপনার (ডিসি) দরজা খোলা রাখুন। যাতে তারা অভিযোগ নিয়ে আপনার কাছে যেতে পারে।
আদালত আরো বলেন, সেই দিন এ মামলায় অভিযোগকারী আপনার কাছে অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আপনার কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। সেদিন যদি আপনি অভিযোগটি শুনতে পেতেন তাহলে হয়তো ঘটনা এত দূর আসত না।
আদালতের স্থগিতাদেশ থাকা সত্ত্বেও ১৩৩ কোটি টাকার সম্পত্তি ১৫ কোটিতে নিলামে বিক্রির ঘটনায় আদালত অবমাননার অভিযোগের শুনানিকালে সোমবার বিচারপতি আবু তাহের মো: সাইফুর রহমান ও বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই মন্তব্য করেন।
ডিসিকে উদ্দেশ করে আদালত আরো বলেন, অভিযোগ শুনেই আপনাকে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো ধরনের উন্নাসিকতা দেখাবেন না। কারণ একজন জেলা প্রশাসক সরকারের হার্ট। আপনাদের দায়িত্ব অনেক। সরকারের সব কাজ আপনাদের দিয়েই বাস্তবায়ন হয়। আপনাদের কাজের ওপর সরকারের ভাবমূর্তি নির্ভর করে। জানি আপনারা অনেক কাজ করেন, কিন্তু তারপরও সাধারণ মানুষের জন্য আপনার দরজা খোলা রাখুন।
সম্পত্তির নিমাল কার্যক্রমের ওপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকার পরও ওই সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করায় আদালত অবমাননার অভিযোগে গত ১১ আগস্ট কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকসহ পাঁচজনকে তলব করেন হাইকোর্ট।
তলব আদেশে গত রোববার হাইকোর্ট হাজির হন ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসাইন, কুষ্টিয়ার ডিসি মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, এসপি মো: খায়রুল আলম ও নিলামে সম্পত্তি নেয়া ব্যবসায়ী আব্দুল রশিদ। পরে তাদের ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন জানান তাদের পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবীরা। কিন্তু অব্যাহতি না দিয়ে হাজির হতে নির্দেশ দিয়ে সোমবার আদেশের দিন ধার্য রাখেন। ওই আদেশ অনুযায়ী ডিসি-এসপিসহ চারজন আজও হাইকোর্ট বেঞ্চে হাজির হন।
সকালে মামলার কার্যক্রম শুরুর পর ডায়াসে কুষ্টিয়ার ডিসি মো: সাইদুল ইসলামকে ডেকে নেয় হাইকোর্ট। তখন ডিসির উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেন, সেই দিন এ মামলায় অভিযোগকারী আপনার কাছে অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আপনার কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। আপনার অফিসের লোকজন অভিযোগ গ্রহণ করেননি। সেদিন যদি আপনি অভিযোগটি শুনতে পেতেন তাহলে হয়তো ঘটনা এত দূর আসত না।
আদালত বলেন, আপনাকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিচ্ছি। তবে সতর্ক করে দিচ্ছি।
আদালত বলেন, আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, ডিসি অফিসে সাধারণ মানুষ যেতে পারেন না। দরজা-জানালায় ভারী পর্দা দেয়া থাকে। যেকোনো মানুষ যাতে আপনার কাছে অভিযোগ নিয়ে যেতে পারে সে জন্য দরজা-জানালায় কোনো ভারী পর্দা রাখবেন না।
আদালত বলেন, আপনারা বিলাসী জীবন-যাপন করেন। সাধারণ মানুষের সাথে আপনাদের তেমন যোগাযোগ থাকে না। লুঙ্গি পরেও যেন একজন মানুষ আপনার কাছে যেতে পারে, সেটাই দেখতে চাই। ভালো কাজ করুন। চুরি-ডাকাতি-গুন্ডামি, দখলবাজি যদি চলে আর এটা যদি আপনার নজরে আসে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিন। নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভালো কাজ করলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
এদিকে জারিকৃত আদালত অবমাননার রুলের ওপর ২৪ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন হাইকোর্ট। ওইদিন কুষ্টিয়ার এসপি মো: খায়রুল আলম, ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন, রশিদ অ্যগ্রো ফুড লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ ও কুষ্টিয়ার সদর থানার ওসি সাব্বিরুল আলমকে আদালতে হাজির থাকতে বলা হয়েছে। তবে ডিসিকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিলেও মামলার রুল শুনানিতে তার আইনজীবীকে থাকতে হবে।
আদালতে ডিসি ও এসপির পক্ষে আইনজীবী মুন্সী মনিরুজ্জামান ও ইউসুফ খান, এমডির পক্ষে সৈয়দ মিনহাজুল হক, আব্দুর রশিদের পক্ষে নুরুল আমিন ও ব্যবসায়ী শফিকুলের পক্ষে রাগীব রউফ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
রাগীব রউফ চৌধুরী জানান, ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলামের মালিকানাধীন বিশ্বাস ট্রেডার্স, ভিআইপি রাইস মিল ও ভিআইপি ফ্লাওয়ার মিলসহ বসত-ভিটা আট একর জমির উপর অবস্থিত। ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ৪২ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তিনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরে ৯০ কোটি টাকা পরিশোধ করেন। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার সম্পত্তির উপর নিলাম ডাকা হয়।
আইনজীবী জানান, শফিকুলের সম্পত্তির মোট মূল্য ১৩৩ কোটি টাকা। যা নিলামে ১৫ কোটি টাকায় বিক্রয় করে দেয়া হয়। তিনি বলেন, নিলামের প্রেক্ষিতে ৪ আগস্টের মধ্যে আমাদেরকে সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতে বলা হয়। পরে ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়। গত ২ আগস্ট হাইকোর্ট নিলাম পরবর্তী সকল কার্যক্রম স্থগিত করে।
একইসাথে এক মাসের মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংককে ২০ কোটি এবং বছরে ৬ কোটি টাকা করে পরিশোধ করতে শফিকুলকে নির্দেশ দেয়। সেই মোতাবেক হাইকোর্টের আদেশের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিবাদিদেরকে ল’ইয়ার্স সার্টিফিকেট দিয়ে অবগত করা হয়। কিন্তু সেই আদেশ না মেনেই নিলামকৃত সম্পত্তি দখলে নেয়ার অভিযোগে আদালত অবমাননার মামলা করেন শফিকুল।
জেএন/কেকে