রক ফসফেট নামক খনিজ পদার্থের সঙ্গে ফসফরিক এসিডের বিক্রিয়ায় যে সার উৎপন্ন হয় সেটির পরিচিতি পাই টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) সার হিসেবে।
কৃষকবান্ধব এই সার ষাটের দশকে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার শুরু হয় । মাঠ ফসল, সবজি ও ফলের বাগানে সর্বজনীনভাবে এই সার ব্যবহার করা যায় বলে এ দেশের কৃষকরা তা সহজে গ্রহণ করেছে এবং বর্তমানে এ সারের ব্যবহার বহু গুণ বেড়েছে ।
আর এ চাহিদাকে পুঁজি করে কৃষিবান্ধব এ সারে গেল কয়েক বছর ধরে জালিয়াতি শুরু করে দিয়েছে একটি সংঘবদ্ধ ভেজাল চক্র। ভেজাল মিশ্রণের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, চক্রটি বিসিআইসির নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গায় অবস্থিত টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটেড থেকে নিয়ে গুদামে পৌছানোর আগে পরিবহনের সময় এই সারে সস্তা জিপসাম, মাটি ও চীন থেকে আনা নিম্নমানের টিএসপি মিশিয়ে দিচ্ছেন।
ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ এই সার ভেজাল করায় কৃষি খাতে সংকট তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই ধরনের ঘটনায় একজন পরিবহন ঠিকাদারকে তালিকাভুক্ত করে আড়াই কোটি টাকার বেশি জামানত জব্দ করা হয়েছে।
সর্বশেষ সোমবার (২৯ আগস্ট) বগুড়া বাফার গুদামে ২৩৮ টন ভেজাল টিএসপি সারসহ ১৭টি ট্রাক জব্দ করা হয়। সার গ্রহণকালে ভেজাল ধরা পড়ায় কর্তৃপক্ষ সারের চালানটি গ্রহণ করছে না। চট্টগ্রাম থেকে বগুড়ায় নেয়ার পথে বস্তা পরিবর্তন করে ভেজাল সার ট্রাকে দেওয়া হয়েছে দাবি করছেন বাফার গুদামের কর্মকর্তারা।
এই সারের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য রাজশাহীর মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। রিপোর্ট হাতে পেলে সারগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে কর্তৃপক্ষ।
তাছাড়া ঘটনাটি তদন্তে টিএসপি কমপ্লেক্সের উপ-প্রধান রসায়নবিদ রেজাউল হক, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মাজহারুল ইসলাম ও সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আউয়াল হোসেনকে নিয়ে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে টিএসপি কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, দেশের একমাত্র ফসফেটিক সার কারখানা টিএসপি কমপ্লেক্সে বছরে ১ লাখ টনের মতো সার উৎপাদন করা হয়। এ কমপ্লেক্স থেকে যশোর, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলার জন্য মাসিক বরাদ্দের টিএসপি সার যশোর বাফার গুদামে আনা হয়।
সেখান থেকে সার বিসিআইসি ডিলারের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করা হয়। গত ৯ জানুয়ারি যশোর বাফার গুদামে সার পরিবহন করার জন্য চট্টগ্রামের মাঝিরঘাটের পরিবহন ঠিকাদার মেসার্স সৈয়দ এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ দেয় টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটেড। এর পর থেকে সার পরিবহন করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি।
চলতি বছরের ১৭ মার্চ চট্টগ্রাম থেকে পাঁচটি ট্রাকে করে ৭০ মেট্রিক টন টিএসপি সার যশোর বাফার গুদামে পাঠানো হলে গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ইনচার্জ) এর সন্দেহ হয়। তিনি সার খালাস না করে ট্রাকগুলো গুদামের বাইরে রাখার নির্দেশ দেন।
পরদিন ১৮ মার্চ বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানান। ট্রাকবোঝাই এসব ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) সারে ভেজাল পাওয়া গেছে। এই সারের ১০টি নমুনা পরীক্ষা করে বিসিআইসি। তার মধ্যে নয়টি নমুনা সম্পূর্ণ ভেজাল এবং একটি নমুনা ‘ভালো নয়’ বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি।
কমিটির ধারণা, চট্টগ্রামের টিএসপি কমপ্লেক্স থেকে এ সার যশোরে আনার পথে সারে ভেজাল উপাদান যোগ করা হয়েছে। এ ঘটনায় পরিবহন ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল, তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিরাপত্তা জামানত টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটেডের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে ভেজালের বিষয়টি অস্বীকার করে পরিবহনকারী ঠিকাদার মেসার্স সৈয়দ এন্টারপ্রাইজের মালিক আহসান হাবীব ২৫ মার্চ শুক্রবার একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, এ সার নকল নয়। সার নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের কোনো কারণ নেই। কারখানা যেভাবে সার দিয়েছে, সেভাবে সার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।’
টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান জানিয়েছেন, ভেজাল সারের বিষয়টি তদন্ত করার লক্ষ্যে টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটেডের উপপ্রধান রসায়নবিদ রেজাউল হককে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
বিসিআইসির উৎপাদন বিভাগের ব্যবস্থাপক শফিকুল কবীর ও বিসিআইসির উপপ্রধান হিসাব রক্ষক নির্মল কুমার দত্তের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা যশোরে এসে ১৯-২০ মার্চ তদন্ত করেন।
চট্টগ্রাম থেকে আসা ট্রাকের কাগজপত্র, ট্রাভেল এজেন্সির কাগজপত্র পরীক্ষা করে কমিটি। কমিটি সারের ১০টি বস্তা থেকে সারের নমুনা সংগ্রহ করে চট্টগ্রামে টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটেড এবং মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক গবেষণাগার, যশোরের পরীক্ষাগারে পরীক্ষার জন্য পাঠায়।
গত ২৪ মার্চ বৃহস্পতিবার ওই পরীক্ষার প্রতিবেদন দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে ৯টি নমুনায় সম্পূর্ণ ভেজালের প্রমাণ পাওয়া গেছে। পরীক্ষায় অবশিষ্ট নমুনাটি ভালোর কাছাকাছি, কিন্তু সম্পূর্ণ ভেজালমুক্ত নয় বলে প্রমাণ মিলেছে।
এর পর ওই দিন সন্ধ্যায় বিসিআইসির এক জরুরি বৈঠক বসে। বৈঠকে পরিবহন ঠিকাদার সৈয়দ এন্টারপ্রাইজকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের ২ কোটি ৬৫ লাখ টাকার মতো সিকিউরিটি মানি জমা ছিল। তা জব্দ করা হয়েছে।
এ ঘটনার রেশ না কাটতেই আবারো টিএসপি সার নিয়ে নানা জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র টিএসপির নামে সারের সাথে মাটি মিশিয়ে বাফার গুদামে পাঠাচ্ছে।
টিএসপি কমপ্লেক্স সূত্র বলছে, এই ধরনের ঘটনা ধরা পড়ার পর ৯ হাজার টন সার পরিবহনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিবহন ঠিকাদার সৈয়দ এম কে এন্টারপ্রাইজকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
ওই ঘটনার সুরাহা হওয়ার আগেই অপর পরিবহন ঠিকাদার এম এইচ আর কর্পোরেশনের পরিবহন করা ট্রাকবোঝাই টিএসপিতে ভেজাল করার অভিযোগে চট্টগ্রাম থেকে বগুড়ায় পাঠানো ১৭ ট্রাক টিএসপির খালাস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৬ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৬ লাখ টন, টিএসপি ৭ লাখ টন, ডিএপি ১৬ লাখ ৫০ হাজার টন ও এমওপি ৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর এই চাহিদা ছিল ইউরিয়া ২৫ লাখ ৫০ হাজার টন, টিএসপি ৫ লাখ টন, ডিএপি ১৫ লাখ টন ও এমওপি ৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।
চট্টগ্রামের পতেঙ্গার টিএসপি কমপ্লেক্স সূত্র বলছে, তাদের কমপ্লেক্স এর পক্ষ থেকে ৫ জন পরিবহণ ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা এখান থেকে মোট ৪৩ হাজার ৭শ ৫০ টন সার দেশের ২৫টি বাফার গুদামে পৌঁছে দেওয়ার কথা হয়েছে।
যে ৫টি ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে তার মধ্যে এম এইচ আর কর্পোরেশন ২১ হাজার ৬২৫ টন সার নিয়ে ১১টি গুদামে, মেসার্স সৈয়দ এন্টারপ্রাইজ ৯ হাজার টন সার নিয়ে দুটি গুদামে, আলীয়া এন্টারপ্রাইজ ৩ হাজার ৭শ ৫০ টন টিএসপি সার নিয়ে একটি গুদামে, মেসার্স সালাউজ্জামান ৩ হাজার টন সার নিয়ে একটি গুদামে, মেসার্স ব্রাদার্স কর্পোরেশনকে ৬ হাজার ৩শ ৭৫ টন সার নিয়ে ২টি গুদামে সার পৌঁছে দেয়ার কথা।
কিন্তু টিএসপি কমপ্লেক্সের গুদাম থেকে সার বের হওয়ার পর পরিবহণের সময় ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা টিএসপির মধ্যে ৩০ কেজি সার বের করে নিয়ে জিপসাম মেশানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কৃষিবিদরা বলছেন, কৃষি জমিতে টিএসপি সার দিলেও জিপসাম দেয়ার ফলে সারের কোনো কাজ হবে না। আর সময়মতো টিএসপি না পাওয়ায় ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে ১১শ টাকা মূল্যের ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা টিএসপিতে সুযোগ বুঝে ডিলাররা চড়া দাম আদায় করছে। ফলে প্রভাব পড়ছে খোলা বাজারে।
কৃষিতে টিএসপির উপযোগিতা ও চড়া দামের সুযোগ নিয়ে সংঘবদ্ধ ঠিকাদার চক্র নানাভাবে এই সার নিয়ে কারসাজি করে। এর মধ্যে দেশীয় উন্নতমানের টিএসপির সাথে চীন থেকে আনা নিম্নমানের টিএসপি মিশিয়ে বিক্রি করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি মেশানো হয় জিপসাম।
এ ব্যাপারে টিএসপি কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান বলেন, কিছু ঘটনা ঘটছে, যেগুলো আমরা সতর্কতার সাথে দেখছি। তিনি বলেন, বগুড়ায় সারের ব্যাপারে সন্দেহ হওয়ার সাথে সাথে আমরা টিম পাঠিয়েছি। টিম এখনো সেখানে রয়েছে। সারের নমুনা নেয়া হয়েছে। পরীক্ষা করে ভেজালের ব্যাপারটি নিশ্চিত হলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেএন/পিআর