কক্সবাজার শহর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটারের মেরিন ড্রাইভটি এখন বেশ পরিচিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর নির্মিত সড়কের পশ্চিম পাশে বঙ্গোপসাগর, আর পূর্ব পাশে পাহাড়সারি। যানবাহন নিয়ে চলাচলের সময় সড়কের দুই পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষের মনকে সতেজ করে তোলে।
সড়কটি যতই পরিচিতি বাড়ছে ততই ছোট বড় সকল ধরনের যান চলাচল বাড়ছে। প্রতিদিন সমুদ্রসৈকত ভ্রমণে আসা হাজার হাজার পর্যটক, উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিরও কর্মকর্তা-স্বেচ্ছাসেবীসহ সাধারণ মানুষ এ সড়কটিতে চলাচল করে।
অপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে নানা কারণে হুমকির মুখে পড়েছেন ৮৪ কিলোমিটারের মেরিন ড্রাইভটি। চরম দুর্ভোগে পর্যটক ও স্থানীয় বাসিন্দারা। কয়েক মাস আগেই কক্সবাজার পৌরসভা কর্তৃপক্ষ শহরের কলাতলী সড়কের সংস্কারকাজ শুরু হলে এ সড়কের প্রথম দুরাবস্থা শুরু হয়।
প্রশাসনের জোর চেষ্টায় প্রায় তিন মাস বন্ধ রেখে সড়কটি সংস্কার করা হলেও সম্প্রতি সমুদ্রসৈকত থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কারণে সৃষ্টি হয়েছে ভাঙন। তার ওপর যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত পরিবহনের চাপ, মেরিন ড্রাইভের পাশে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘরবাড়ি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই সংস্কারের ব্যবস্থা না নেয়া হলে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে উঠবে সড়কটি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়েছে সাগরের পানির উচ্চতা। ফলে প্রতিনিয়ত বঙ্গোপসাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ আঘাত হানছে মেরিন ড্রাইভের ওপর।
সাগরের বাড়তে থাকা উচ্চতা এবং পাড়ের অব্যাহত ভাঙনে তলিয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের পাশ ঘেঁষে তৈরি এ সড়কের কিছু অংশ পূর্ণিমার জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়। বিশেষ করে কলাতলী থেকে সাবরাং পর্যন্ত সড়ক চরম ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
সরজমিনে দেখা গিয়েছে, মেরিন ড্রাইভের কক্সবাজার অংশের কলাতলী, দরিয়ানগর, বড়ছড়া, হিমছড়ি, ইনানী, পাটুয়ারটেক, সি-পার্ল হোটেলের সামনেসহ টেকনাফের সাবরাং পর্যন্ত অংশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সড়ক রক্ষায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিকল্প ব্যবস্থায় এ ভাঙন প্রতিরোধ করা না হলে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কটি শিগগিরই হয়তো বিলীন হয়ে যাবে।
অন্যদিকে মেরিন ড্রাইভকে ঘিরে যে পর্যটন গড়ে উঠেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাপে তার সম্ভাবনাও নষ্ট হতে চলেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। শামলাপুর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারজুড়ে সড়কের দুই পাশে বসবাস করতে শুরু করেছে হাজারো রোহিঙ্গা নাগরিক।
তারা নির্মাণ করেছে অসংখ্য ঝুপড়ি ঘর। ফলে সৈকতের পাশ দিয়ে যাওয়া এ সড়কটির যে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য সেটি আর ধরে রাখা যাচ্ছে না।
আবার শরণার্থীদের সহায়তা দিতে দেশে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর গাড়ির অতিরিক্ত চাপও মেরিন ড্রাইভের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে।
কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলেন, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত দেখতে কক্সবাজার আসেন লাখ লাখ দেশী-বিদেশী পর্যটক। কলাতলী হয়ে চলমান সাবরাং এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোনে চলে যান অনেকে। সেখানে পথের ভাঙন, অতিরিক্ত গাড়ির চাপ বা দুই পাশে শরণার্থীদের বসতি—কোনোটিই পর্যটকদের জন্য সুখকর নয়।
কক্সবাজার পিপলস ফোরামের মুখপাত্র সাংবাদিক এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে মেরিন ড্রাইভ সড়ক করা হয়েছিল তা ভেস্তে যাওয়ার পথে। কেবল শরণার্থী বসবাসই সমস্যা নয়, তাদের কারণে এ সড়কে বেড়েছে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার জন্য চলাচলরত বাহনের সংখ্যা। তার ওপর ভাঙনপ্রবণ কিছু এলাকা তো রয়েছেই।
এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে সড়কটি ভেঙে যাবে। তাই পর্যটকবাহী গাড়ি ছাড়া অন্যান্য কাজে ব্যবহূত গাড়ি চলাচলের জন্য বিকল্প সড়ক নির্মাণ করা উচিত। এছাড়া প্রভাবশালীদের সৈকত থেকে বালি উত্তোলনও বন্ধ করতে হবে। তা না হলে চমত্কার এ সড়কটি আর রক্ষা করা যাবে না। চলে যাবে সমুদ্রগর্ভে।
সড়কটি দিয়ে কিছু কিছু যানবাহন চলাচলে সীমাবদ্ধতার আদেশ দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী। পাশাপাশি অবৈধ বালি উত্তোলনও বন্ধ করা প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, মেরিন ড্রাইভ সড়কের কলাতলী সাবমেরিন কেব্ল ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে দক্ষিণ দিকে বেলি হ্যাচারি পর্যন্ত চার কিলেমিটার মেরিন ড্রাইভ ১৯৯১ সালের জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হয়। এখন পর্যন্ত সেটির সংস্কার হয়নি। লোকজন মেরিন ড্রাইভে যাতায়াতের বিকল্প হিসেবে এত দিন কলাতলী সড়কটি ব্যবহার করে আসছিলেন। কক্সবাজার পৌরসভার নিজস্ব অর্থায়নে ওই সড়কের সংস্কারকাজ শুরু করে।
১৯৯১-৯২ সালে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণকাজ শুরু করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৮৪ কিলোমিটার সড়কটি ২০১৭ সালের ৬ মে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর থেকে মেরিন ড্রাইভের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
জেএন/পিআর