দেশের অর্থনীতির প্রাণ কর্ণফুলী নদী মরণদশা থেকে রক্ষা পাচ্ছে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং বা মৌলিক খনন প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের পথে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সদরঘাট থেকে বাকলিয়া পর্যন্ত নদীর প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশে ৪ মিটার গভীরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে সুফল পাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। প্রাণ ফিরে পেয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই নদী।
নগরীর সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত মোট আটটি খাল দিয়ে নানা বর্জ্য ও আবর্জনা এই নদীতে এসে পড়ত। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, এই নদীর কোনো কোনো অংশে ২১ ফুট পর্যন্ত পলিথিনের স্তর জমেছিল। নানা প্রকার আবর্জনায় এক প্রকার চর পড়েছিল এই নদীতে। জেগে ওঠা চরের কারণে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। এতে চট্টগ্রাম বন্দরেরও স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ নদীর তলদেশ থেকে বিভিন্ন প্রকার বর্জ্য এবং পলিথিন সরিয়ে অসাধ্য সাধন করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ১৩ ফুট পর্যন্ত পলিথিনের স্তর থাকার ধারণা নিয়ে ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু ড্রেজিং করতে গিয়ে কোনো কোনো এলাকায় ২১ ফুট পর্যন্ত পলিথিনের স্তর মেলে। এতে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে খননকাজ। শুধু তাই নয় নদীর তলদেশ স্ফীত হওয়ার কারণে নগরীর কোনো কোনো এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালে এই নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিং কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের ফলে ৪০০ মিটার জেটি সচল হওয়ায় বন্দরের আয় হচ্ছে বছরে ৮০ কোটি টাকা। এখন জেটিতে ভিড়তে পারছে বড় জাহাজ, লাইটার জাহাজ বেশি পরিমাণে নদীতে নোঙর করতে পারছে এবং নদীর তীরে সদরঘাট এলাকায় তিনটি লাইটার জেটি সবসময় চালু আছে। ফলে বহির্নোঙর থেকে পণ্য জেটিতে নামানো সহজ হচ্ছে। খরচও কমছে পণ্য খালাসে। এছাড়া নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পাওয়ায় লাইটারেজ জাহাজ চলাচল এবং বন্দরের অন্যান্য কার্যক্রমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে।
এছাড়া ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের ফলে শাহ আমানত সেতুর ঝুঁকি কমেছে। আগে শাহ আমানত সেতুর দুটি পিলারের মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো; এখন চারটি পিলারের মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফিশারীঘাট মাছ বাজার এলাকায় আগে ২০০-৩০০ মিটার দূরে মাছ আনলোড করতে হতো; এখন সরাসরি ঘাটেই মাছ আনলোড করা যাচ্ছে। ফলে সময় ও টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের ফলে কর্ণফুলী নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বর্ষায় শহরে জলাবদ্ধতা কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১১ সালে মালয়েশিয়ান মেরিটাইম অ্যান্ড ড্রেজিং করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান কাজটি করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। প্রকল্পের কাজ শুরুর দুই বছর না যেতেই কাজ অসমাপ্ত রেখে এ প্রতিষ্ঠান চলে যায়। মূল ঠিকাদার স্থানীয় এক এজেন্টকে প্রকল্পের সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়োগ করে। কিন্তু তারা কাজটি করতে সক্ষম হয়নি বিধায় ২০১৩ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ মালয়েশিয়ান, মেরিটাইম অ্যান্ড ড্রেজিং করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তিটি বাতিল করে। এমনকি বিশ্ববিখ্যাত চীনা কোম্পানি চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড থেকে ৩২ ইঞ্চি ব্যাসের শক্তিশালী কাটার সাকশন ড্রেজার এনেও পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা সম্ভব হয়নি। চীনা কোম্পানিও তাদের অপারগতা মেনে নিয়ে প্রকল্প থেকে চলে যায়।
এছাড়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বিআরটিসি (বুয়েট) দিয়ে সমীক্ষা করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ১৩ ফুট পর্যন্ত পলিথিন থাকার ধারণা নিয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করেছিল। তবে প্রকল্পের কাজ শুরুর পর পলিথিনের স্তর মিলেছে ২১ ফুট পর্যন্ত। অতিরিক্ত পলিথিনের কারণে ড্রেজিংয়ের কাজে বড় ধরনের বাধার সৃষ্টি হয়।
প্রকল্পে এত সমস্যা ও বাধা-বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও বন্দর কর্তৃপক্ষের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ই ইঞ্জিনিয়ারিং অনেকটা আটঘাট বেঁধেই নামে। করোনা পরিস্থিতি, তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও প্রকল্পের কাজ নিরবচ্ছিন্নভাবে চলমান রাখা হয়।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, প্রকল্পের স্বার্থে বিশ্বসেরা আইএইচসি ব্র্যান্ডের তিনটি কাটার সাকশন ড্রেজারসহ লংবুম এক্সকাভেটর, শর্টবুম এক্সকাভেটর, ভাসমান বার্জসহ গ্রাব ড্রেজার, এম্ফিবিয়ান ড্রেজারসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের অসংখ্য ড্রেজিং সরঞ্জাম দিয়ে খননের কাজ এগিয়ে চলেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ হাইড্রোগ্রাফার ও প্রকল্প পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ আরিফুর রহমান বলেন, সব চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে প্রকল্পের কাজ প্রায় ৯৪ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ইতিমধ্যে কর্ণফুলী নদী ফিরে পেয়েছে তার স্বাভাবিক গতি, বৃদ্ধি পেয়েছে নাব্য। তিনি বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের জেটির একটি অংশ সচল হয়েছে। এর ফলে বন্দরের আয় হচ্ছে বছরে ৮০ কোটি টাকা। সচল হয়েছে সদর ঘাটের তিনটি লাইটার জেটি।
প্রসংগত, ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে কর্ণফুলী নদীর উৎপত্তি। পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম হয়ে এটি বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
এদিকে, এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, খননের ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের দরুন কর্ণফুলী নদীর বন্দর চ্যানেলের নাব্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। ঝুঁকি কমেছে শাহ আমানত সেতুরও। পূর্বে যেখানে শাহ আমানত সেতুর শুধুমাত্র দুটি পিলারের মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো, বর্তমানে সেখানে চারটি পিলারের মধ্যে দিয়ে পানি অবাধে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর নাব্য বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকল্প এলাকায় ছোট-বড় লাইটার জাহাজ বেশি পরিমাণে নদীতে নোঙর করতে পারছে। নতুন ফিশারি বাজার ঘাটসংলগ্ন এলাকায় পূর্বে যেখানে ২০০ থেকে ৩০০ মিটার দূর থেকে মাছ আনলোড করতে হতো, বর্তমানে সেখানে সরাসরি ঘাটেই মাছ আনলোড করা যাচ্ছে। এর ফলে অর্থ ও সময়ের সাশ্রয় হচ্ছে। চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনেও প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে খননকাজ চালু থাকলেও বড় সমস্যা রয়ে গেছে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য। সিটি করপোরেশন এলাকার বর্জ্যগুলো সরাসরি নদীতে পড়ায় তা আবারও ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম বলেন, বর্জ্য যাতে নদীতে না যায়, সে লক্ষ্যে সরকার তথা সিটি করপোরেশন প্রকল্প নিতেই পারে। কিন্তু জনগণ সচেতন না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রতিনিয়ত সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করছেন। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে, কর্ণফূলী নদী আমাদের প্রাণ। এটি রক্ষা করার জন্য আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘অবশ্যই ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের সুফল বন্দর কর্তৃপক্ষ পেতে শুরু করেছে। সদরঘাটের লাইটার জেটিগুলো সচল হয়েছে। শাহ আমানত সেতুর নিচ দিয়ে পানির প্রবাহও বেড়েছে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে ড্রেজিংয়ের কারণে। তবে এটা ধরে রাখতে সুষ্ঠু মেইনটেন্যান্সের বিকল্প নেই। খাল থেকে পলিথিন ও বর্জ্য নদীতে এসে পড়া বন্ধ করতে হবে। এজন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একটি প্রকল্প নিয়েছে বলে জানি।’
জেএন/কেকে