চলতি সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য কমিটি গঠন করেছে, পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক কমিটিও গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
এরই প্রেক্ষাপটে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে অভিভাবকেরা তাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা জানিয়ে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন।
অভিভাবকরা বলছেন, এমনিতে দেশে চাকরির অনিশ্চয়তা এবং লেজুড়বৃত্তি রাজনীতিতে ক্যাম্পাসে সহিংসতার কারণে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বিদেশমুখী প্রবণতা রয়েছে।
সেক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি সরব হলে মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা মুখ ফিরিয়ে নেবে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে।
অভিভাবকরা তাদের উদ্বেগের কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে তাদের আশ্বস্ত করতে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি ঠেকাতে নিজ নিজ শিক্ষার্থীদের কড়া বার্তা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ছাত্ররাজনীতিতে জড়ালে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বহিষ্কারের হুঁশিয়ারিও দিয়েছে।
গত দুই দিনে এখন পর্যন্ত আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছে নোটিশ পাঠিয়েছে।
এছাড়া শিক্ষার পরিবেশ এবং সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা বজায় রাখার স্বার্থে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি করার অনুমতি দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক এম এম শাহিদুল হাসান।
এআইইউবি তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জানিয়েছে, ‘উচ্চশিক্ষার জন্য এআইইউবি একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এআইইউবির কোড অব কন্ডাক্ট পালন করার জন্য শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের কিছু বিষয় স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
এর মধ্যে আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কিংবা রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। যেকোনও ধরনের সংগঠন প্রতিষ্ঠার আগে ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।
বিনা অনুমতিতে ইউনিভার্সিটির নাম কিংবা লোগো কোনও অনুষ্ঠান, কোনো সংগঠন কিংবা কোনো কর্মসূচিতে ব্যবহার করা যাবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোড অব কন্ডাক্টের কোনও ব্যত্য়য় ঘটলে তা গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে।’
প্রায় অভিন্ন বক্তব্য দিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ও শিক্ষার্থীদের ইমেইলে জানিয়েছে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় একটি রাজনীতি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান এবং কোনো রাজনৈতিক ক্লাব বা সংগঠনকে সমর্থন করে না।
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দিয়েছে, অতীতেও অনেকে ইস্ট ওয়েস্ট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ঢোকানোর পাঁয়তারা করেছেন। তবে তারা সফল হননি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়ম-নীতি মেনে চলে সব সময়ই।
এ ব্যাপারে আমরা খুবই কঠোর। আমরা কারো সঙ্গে আপস করিনি, করবও না। শিক্ষার পরিবেশ এবং সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা বজায় রাখার স্বার্থে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাজনীতি টলারেট করবে না।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ‘সম্প্রতি আমরা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সম্পর্কে অভিভাবক ও ছাত্রদের কাছ থেকে উদ্বেগপূর্ণ বেশ কয়েকটি প্রশ্ন পেয়েছি।’
এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দক্ষতা উন্নত করার জন্য অনেকগুলো ক্লাব রয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ এবং কোনো রাজনৈতিক ক্লাব বা সংগঠনকে সমর্থন করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের কোনো কার্যক্রম করা যাবে না।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্যরা অবশ্যই তাদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মূল্যবোধ অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বা সমিতির ব্যক্তিগত স্বার্থ অনুসরণ করার ক্ষেত্রে স্বাধীন।
এছাড়া ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির লোগো কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমোদন ছাড়া কোনো সাংগঠনিক কার্যকলাপের প্রচারের জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
এদিকে বেশির ভাগ অভিভাবকও চাইছেন না তার সন্তান রাজনীতিতে জড়াক। তারা বলছেন, ছাত্ররাজনীতির অনেক ইতিবাচক দিক থাকলেও বাংলাদেশের চলমান ছাত্ররাজনীতি সুখকর নয়।
একটি সংগঠন কমিটি করলে স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য ছাত্রসংগঠনও কমিটি গঠন করবে। এক দল কর্মসূচি দেবে, অন্য দল তাতে বাধা দেবে। ক্যাম্পাসে অস্থিরতা বাড়বে। বাড়বে সেশনজট।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পরিবেশ, সংস্কৃতি ও কাঠামো সেখানে রাজনীতি যদি কর্তৃপক্ষ না চায়, তা হলে সেটা প্রবেশ করানোর চেষ্টা করা যাবে না।
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা, প্রশাসনিক, আর্থিক ও অন্য কার্যাদি সম্পাদন সম্পর্কিত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়-সংবিধির গাইডলাইনের খসড়া অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা রাজনীতি করতে পারবেন না। একই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা দলীয় রাজনীতির অংশ হতে পারে কীভাবে- সে প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের।
তবে এ বিষয়ে গতকাল সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, গণতান্ত্রিক সমাজ চাইলে, সচেতন মানুষ চাইলে, দায়িত্বশীল সুনাগরিক-বিশ্ব নাগরিক গড়তে চাইলে রাজনৈতিক সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
তবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, তা সেই প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তিনি বলেন, রাজনীতি করা মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি অংশ। এখন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কী নিয়মকানুন করল, কোন রাজনৈতিক দলের কী ব্যবস্থা হলো, সেটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের বিষয়। সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঠিক করে না।
এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপও করে না। তবে অনেক মত আছে। কেউ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। কেউ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক চর্চা থাকা উচিত।
জেএন/পিআর