স্বাধীনতা লাভের পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই বিকশিত হয়েছে। অর্থনীতির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপে নানা পরিবর্তন ঘটেছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্প ও সেবানির্ভর অর্থনীতির নতুন রূপ এখন আমাদের সামনে দৃশ্যমান।
শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এসবের একটি প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে বিমা খাতেরও বিস্তৃতি ঘটেছে। যদিও অর্থনীতির আরেকটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে ব্যাংকিং খাতের যতটা অগ্রগতি হয়েছে সে তুলনায় বাংলাদেশে বিমা খাতের তেমন সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়নি।
আকার, আয়তন, সংখ্যায় বিমা খাতের প্রসার ঘটলেও প্রকৃতপক্ষে গুণগত উন্নতি লাভ ঘটেনি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে যেতে পারেনি। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশের বিমাশিল্প বেশ পিছিয়ে আছে।
শিল্পকারখানা স্থাপন, পরিচালনা, উৎপাদন, বিপণন-বিতরণ, বাজারজাতকরণ—প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদ্যমান ঝুঁকির নিরাপত্তা বিধানে বিমাকরণ বিধিদ্ধভাবে আবশ্যিক ব্যাপার হিসেবে বিবেচিত বলেই এটাকে গুরুত্বহীন কিংবা অপ্রয়োজনীয় ভাবার কোনো অবকাশ নেই।
বর্তমান প্রাত্যহিক জীবনযাপনেও বিদ্যমান ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পেতে বিমার কোনো বিকল্প নেই। অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় ইত্যাদির পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকির বিপরীতেও নিরাপত্তা দিতে বিমাকরণের প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।
তবে এজন্য মানুষের অজ্ঞতা, অসচেতনতার পাশাপাশি বিভিন্ন বিমা প্রতিষ্ঠানের অনুন্নত সেবার মান, প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড, হয়রানিমূলক আচরণ, অপেশাদার মনোভাব, বিমাকর্মীদের অমানবিক, অদক্ষ আচরণ এক্ষেত্রে আস্থাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে আজও। দুর্যোগপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিমা খাতের উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকলেও এ খাতের প্রতি মানুষের দীর্ঘদিনের আস্থার সংকটের কারণে সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে বিমার আওতায় রয়েছে ৮ শতাংশের কম মানুষ। জিডিপিতে এ খাতের অবদান মাত্র দশমিক ৫৫ শতাংশ। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তা ৪ শতাংশেরও বেশি।
এখানে বিমা খাতের প্রতি সাধারণভাবে আস্থাসংকটের কারণগুলো কী—খুঁজতে গেলে যা সহজে চোখে পড়ে, গ্রাহকদের বিমা দাবি পূরণে কোম্পানিগুলোর অনীহা, দক্ষ জনবলের অভাব, বিমা কোম্পানিগুলোর পেশাদারিত্বের ঘাটতি, সামগ্রিকভাবে এ খাতের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন বিমাপণ্য না আসা, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব, প্রযুক্তিগত দক্ষতায় পিছিয়ে থাকা, প্রয়োজনীয় যুগোপযোগী আইনকানুনে ঘাটতি এবং কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিরাজমান অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
এ দেশে অতীত সময় থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে বিমা খাতের প্রতি নেতিবাচক ভাবমূর্তি বিরাজ করছে।
বিমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকের দাবি পরিশোধে টালবাহানা করে, যথাসময়ে পরিশোধ না করার ক্ষেত্রে অহেতুক অজুহাত খাড়া করে। ফলে হয়রানির শিকার হতে হতে গ্রাহক তথা সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সাধারণত মানুষ একান্ত বাধ্য না হলে বিমা কোম্পানির দ্বারস্থ হতে চায় না। এতে করে সামগ্রিকভাবে বিমা শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
বর্তমানে দেশে ৭৮টি বিমা কোম্পানির কাজ করছে, যার মধ্যে জীবনবিমা কোম্পানি ৩২টি এবং সাধারণ বিমা কোম্পানি ৪৬টি। এই ৭৮টি কোম্পানির মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন জীবন বীমা করপোরেশন এবং সাধারণ বীমা করপোরেশনসহ বিদেশি কোম্পানি মেটলাইফ আলিকোর শাখা অফিসও রয়েছে। বিদেশের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় ভারতের এলআইসি বাংলাদেশ লিমিটেড কার্যক্রম পরিচালনা করছে বেশ কিছুদিন ধরে।
বিমা করপোরেশন আইন অনুসরণে ১৯৭৩ সালের ১৪ মে সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা নামে দুটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৪ সালে সরকার প্রথমবারের মতো বেসরকারি খাতে বিমার সব ক্ষেত্রে ব্যবসায়ের অনুমতি দেয়।
বর্তমানে শেয়ারবাজারে ৪৭টি বিমা কোম্পানি তালিকাভুক্ত। জীবন ও সাধারণ বিমা মিলিয়ে এখনো বাংলাদেশের বিমা বাজারের পরিসর তেমন বড় নয়, সর্বসাকুল্যে প্রিমিয়াম আয় ১৩ হাজার কোটি টাকা প্রায়।
বিশ্বে বিমাশিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৬তম। বলা যায়, বৈশ্বিক বিমাশিল্পের তুলনায় বাংলাদেশের বিমাশিল্প অনুল্লেখ্য অবস্থানে দশমিক শূন্য ৩ (০.০৩) শতাংশ মাত্র। এখানে মাথাপিছু বিমা ব্যয় কেবল ২ দশমিক ৬ মার্কিন ডলার। বৈশ্বিক বিমাবাজারে মন্দাবস্থা বিরাজ করলেও বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে এর দৃশ্যমান প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে।
শিল্প প্রধান দেশগুলোতে জীবন বিমায় ৩ দশমিক ৫ এবং সাধারণ বিমায় ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। সেক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশে জীবন বিমায় ৭ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সাধারণ বিমায় প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। আমাদের বিমা খাতকে এখনো আরো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
সরকারি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ আইডিআরএ কাজ করছে বিমা খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করা এবং সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গ্রাহক ও কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে নানাভাবে।
জনবলসংকটের কারণে এখনো শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠন করা সম্ভব হয়নি। তবে দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত জনবলসংকটের কারণে এখনো যথার্থ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠন করা যায়নি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধি ও প্রবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। আইডিআরএ এখনো যথার্থ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বিমা কোম্পানিগুলোর ওপর।
একটি কথা অবশ্যই মানতে হবে, যে দেশের বিমা খাত যত শক্তিশালী, সে দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী। বিমার গ্যারান্টি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিমার প্রতি মানুষের অনীহা লক্ষ করা যায় সাধারণভাবে। আমাদের সমাজে এটা বিদ্যমান। এটা দূর করতে হলে সরকারি নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে।
ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ জীবনযাপনের নানা বিষয় বিমার আওতায় আনার ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শুধু শহর এলাকার মানুষ, কলকারখানা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যাংক ঋণ কার্যক্রম, পরিবহন, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদির মধ্যে বিমা খাতকে সীমাবদ্ধ না রেখে কৃষি খাত, কৃষক, উত্পাদিত ফসল, কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতকরণ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগির খামার, হাওর, কৃষিজমিকে বিমার আওতায় আনার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
আজকাল কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি কোষাগার থেকে সাহায্যের হাত বাড়াতে হয়। যদি তা বিমাকৃত হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানি ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে তার সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করবে। বিমার ব্যাপারে সাধারণের মধ্যে যে অনীহা ভাব, অসচেতনতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার বিরাজমান তা দূর করতে বাস্তবমুখী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুধাবনের মাধ্যমে উত্সাহী করে তুলতে হবে।
সাধারণত, সরকারি নির্দেশনা ছাড়া মানুষ কিছু করতে চায় না। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা জারির মাধ্যমে বিমার প্রতি সবাইকে আকৃষ্ট করতে হবে। এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে মানুষ উপকৃত ও লাভবান হন—এটা বোঝাতে হবে সবাইকে। বাজার অর্থনীতিতে বিমা খাত বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সাধারণ বিমা সরাসরি সম্পৃক্ত। মাথাপিছু গড় আয়, শিক্ষার হার, স্বাস্থ্যসচেতনতা ইত্যাদির সঙ্গে জীবন বিমার সম্পৃক্ততা থাকে। এসব মানদণ্ডে আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিমা খাতের অগ্রগতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। এর জন্য দুর্বল রেগুলেটরি অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে দায়ী করা যায়।
আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের সহযোগিতায় অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বিমা আইন, ২০১০ পাশ হয়েছে। দীর্ঘ চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে বিমা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইনসিওরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ) কার্যক্রম শুরু করেছে আরো বেশ কয়েক বছর আগেই।
ইতিমধ্যে এই সংস্থা অনেকগুলো বিধিমালা, প্রবিধিমালা, প্রণয়ন করেছে। এই সব বিধিমালা ও প্রবিধিমালা বাস্তবায়িত হলে বিমা খাতে প্রত্যাশিত উন্নয়ন সাধিত হবে। আমাদের দেশে এত বেশিসংখ্যক বিমা কোম্পানির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কি না, তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন।
অধিকসংখ্যক বিমা কোম্পানি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এখানে উন্নতমানের বিমা সেবার নিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়নি। অনেক বিমা কোম্পানি গ্রাহকদের প্রিমিয়ামের অর্থ আত্মসাতের ধান্ধায় নিয়োজিত থাকায় এ খাতে সুস্থ পরিবেশ সুনিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে নজরদারি আরো বাড়াতে হবে। নতুন বিমা কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়ার সময় রাজনৈতিক বিবেচনা ও পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদিকে গুরুত্ব না দিয়ে অর্থনৈতিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। বিমা খাতের অনেক কোম্পানি নির্ধারিত সীমার চাইতে বেশি ব্যয় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
করপোরেট সুশাসনের বিষয়টিও এখানে প্রায়ই উপেক্ষিত রয়ে যাচ্ছে। প্রিমিয়াম সংগ্রহ, পুনর্বিমা, বিমা দাবি নিষ্পত্তিসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে প্রায়ই। বিমা উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক-ইনসিওরেন্স চালুর বিধান করছে।
বিমা খাতের উন্নয়নে ব্যাংক-ইনসিওরেন্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার উদাহরণ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোতে রয়েছে। বিশেষ করে জীবন বিমার মতো দীর্ঘমেয়াদি পলিসির প্রসারে ব্যাংক-ইনসিওরেন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, আশা করা যায়।
এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিমা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশ-বিদেশে উন্নতমানের আধুনিক প্রশিক্ষণ লাভেরও যথেষ্ট সুযোগ পাচ্ছেন বিমা পেশায় নিয়োজিতরা। ফলে এক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব এবং উন্নত সেবা প্রদানের সাবলীল পরিবেশ গড়ে ওঠা উচিত। লেখক : প্রাবন্ধিক
জেএন/পিআর