সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ছোঁয়াচে রোগ কনজাংকটিভা বা চোখের প্রদাহ। একে চোখ ওঠা রোগও বলা হয়। আক্রান্ত হচ্ছেন সব বয়সী মানুষ। তবে শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে রোগটির সংক্রমণ অধিক বলে জানা যায়। সতর্ক না হলে এ রোগ থেকে কর্নিয়ার আলসার ও অন্ধত্বের মতো গুরুতর অবস্থাও হতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। অধিক মাত্রায় ছোঁয়াচে হওয়ায় এই রোগে আক্রান্ত হলে নিজে সতর্ক হতে হবে, দ্রুত নিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ।
গত জুলাই থেকেই এ রোগের বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। সেপ্টেম্বরে এসে বেড়েছে প্রকোপ। একসঙ্গে খেলাধুলা ও সতর্কতা ছাড়াই সংস্পর্শে আসার কারণে শিশুদের রোগটি বেশি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সম্প্রতি বান্দরবান ভ্রমণ করে ফিরেছেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান। থাকেন মেসে। তিনি জানান, বান্দরবান থেকে বাসায় আসার পর থেকেই দেখেন চোখ জ্বালা করছে এবং চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আয়নায় দেখেন চোখ লাল হয়ে আছে, ফুলে গেছে চোখের পাতা। পরে একে একে মেসে থাকা আটজনের মধ্যে পাঁচজনই আক্রান্ত হন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক ডা. জাকিয়া সুলতানা বলেন, চোখের এই রোগ সংক্রামক হলেও বাতাসে ছড়ায় না। আক্রান্ত ব্যক্তির চোখের সংস্পর্শে আসা কোনো জিনিস যেমন চোখে হাত দেওয়ার পর সেই হাত যেখানেই ছোঁয়ানো হয়, টাওয়েল, রুমাল ইত্যাদি অন্যের চোখের সংস্পর্শে এলে তার মধ্যেও ছড়ায়। তাই অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। নিজের ব্যবহার করা কাপড় কিংবা টাওয়েল আলাদা রাখতে হবে। যেখানে-সেখানে ব্যবহৃত টিস্যু ফেলা যাবে না। আর এই সময়ে বাসায় বিশ্রাম নিলে অন্য কেউ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে।
‘এটি ব্যাকটেরিয়াল কনজাংকটিভাইটিস বা ভাইরাল কনজাংকটিভাইটিস- দুটিই হতে পারে। তবে এই মুহূর্তে ভাইরাল কনজাংকটিভাইটিসই বেশি হচ্ছে। ব্যাকটেরিয়ালটাও অনেকের ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে রোগী এসে আমাদের জানায় চোখ লাল হয়ে গেছে, চোখের পাতা ফুলে গেছে, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, চোখ খচখচ করছে- এ ধরনের সমস্যার কথা।’
এই চিকিৎসক আরও বলেন, এসময় যদি আমরা দেখি রোগীর চোখে আঠা আঠা হচ্ছে কিংবা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর অনেক বেশি পিচুটি থাকছে তখন বুঝি এটি ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস। বর্তমানে যেটি দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে চোখের মধ্যে পানিজাতীয় জিনিস বেশি আসছে। এক্ষেত্রে আমরা ধরে নেই যে এটি ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস। বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশই এই সমস্যা নিয়ে আসছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংক্রমক রোগ বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘এই সমস্যাকে কনজাংকটিভা বা চোখের প্রদাহ বলে। এটি নানা কারণে হতে পারে। যেমন- এলার্জি, বায়ুদূষণ, চোখে তীব্র আলো পড়া ইত্যাদি। এগুলো এ সমস্যার অসংক্রামক কারণ। তবে সম্প্রতি যে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, এটি সম্ভবত কোনো সংক্রামক জীবাণুর মাধ্যমে ছড়াচ্ছে।’
এই রোগ সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে জানিয়ে ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, কখনো কখনো এটি কর্নিয়ায় ছড়ায়, এতে কর্নিয়ার আলসার এমনকি অন্ধত্বের দিকে চলে যেতে পারে। এত হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। একাধিক স্কুলে এ ধরনের ঘটনা দেখা দিলে স্বাস্থ্য বিভাগকে সতর্কতা জারি করতে হবে। প্রয়োজনে সেসব স্কুলে সাময়িক ছুটি দেওয়া যেতে পারে।
সাধারণভাবে এ রোগ সাত থেকে আটদিনে ভালো হয়ে যায় জানিয়ে ডা. জাকিয়া সুলতানা বলেন, এ রোগের ক্ষেত্রে সঠিক ওষুধ না ব্যবহার করলে বা চিকিৎসকের পরামর্শ না নিলে অনেক সময় দেখা যায় এটি চোখের কর্নিয়ায় ছড়িয়ে যেতে পারে। যাকে আমরা বলি কেরাটো কনজাংটিভাইটিস। সাধারণভাবে যেটি সাত-আট দিনে ভালো হয়ে যায়। তবে কর্নিয়ায় আক্রান্তের ফলে সুস্থ হতে ১৫-২০ দিনও লেগে যায়। এছাড়া এর থেকে আরও খারাপ দিকেও যেতে পারে। তাই কারও এ সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে জেনে নেওয়া উচিত তার কোন ধরনের কনজাংটিভাইটিস। এরপর পরামর্শ অনুযায়ী চলাফেরা করলে দ্রুতই এ রোগ সারবে।
এই রোগের সঙ্গে করোনাভাইরাসের সম্পৃক্ততা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোভিডের সময় চোখের প্রদাহ দেখা দিয়েছিল। তবে বর্তমানে করোনার সংক্রমণ তেমনটা নেই। এই সময়ে করোনা না থাকলেও এ রোগটি ছড়াচ্ছে। তাই একে করোনার কারণে হচ্ছে এমনটা বলা যাবে না।
যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে
চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মতে চোখ ওঠা রোগে আক্রান্ত হলে সচেতন থাকা, বেশি বেশি হাত ধোয়া, সংক্রমিত চোখ/চোখ দুটি বেশি না ছোঁয়া, নিজের তোয়ালে ও প্রসাধনী অন্য কাউকে ব্যবহার করতে না দেওয়া উচিত। এতে অন্যরা সংক্রমিত হবে না। এছাড়া চোখে কোনো ওষুধ ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এছাড়া কারও চোখের প্রদাহ ও জ্বর একই সঙ্গে থাকলে তার করোনা টেস্ট করানো উচিত।
জেএন/কেকে