মো. আমির হোসেন (৫২)। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকেন্দ্রিক একটি অজ্ঞানপার্টি চক্রের মূলহোতা তিনি। চাকরি করেন বিমানবন্দর এলাকায় একটি ফাস্টফুডের দোকান। তবে এ পেশার আড়ালে জড়িত অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। গত ১৫ বছরে বিদেশফেরত প্রায় ৩০০ যাত্রীকে কৌশলে অজ্ঞান করে তাদের কাছ থেকে মূল্যবান মালামালসহ সর্বস্ব লুট করে নিয়েছে তাদেরই একটি চক্র।
র্যাব জানিয়েছে, অপরাধ কর্মে জড়িত এ চক্রের মূলহোতাও আমির হোসেন। আমিরের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ১৫টির বেশি মামলা থাকলেও বিভিন্ন সময়ে কারাভোগ করে জামিনে মুক্ত হয়ে আবারও একই অপরাধ কর্মে জড়াতো সে। চক্রের মূলহোতাসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এ চক্রে আরও ৬-৭ জন বিভিন্ন সময়ে যুক্ত ছিলেন। যাদের একাধিক সদস্য বর্তমানে কারাগারে।
র্যাব জানায়, এ চক্রের সদস্যরা বিমানবন্দর টার্মিনালে ওঁত পেতে থাকতো এবং প্রবাসীদের টার্গেট করতে টার্মিনালে হাতে পাসপোর্ট ও লাগেজ নিয়ে প্রবাসফেরত যাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণ করতো।
গতকাল শনিবার রাতে র্যাব-১ এর একটি আভিযানিক দল বিমানবন্দর থানা ও কদমতলী থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে অজ্ঞানপার্টি চক্রের মূলহোতা মো. আমির হোসেন (৫২), তার সহযোগী মো. লিটন মিয়া ওরফে মিল্টন (৪৮), আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে পারভেজ (৩৫) ও জাকির হোসেন (৪০) গ্রেফতার করে। এসময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় মোবাইল ফোন, অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহৃত ট্যাবলেট, যাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণে ব্যবহৃত লাগেজ ও চোরাই সোনা (যার রূপ পরিবর্তন করতে গলানো হয়েছে)। আমির হোসেন বর্তমানে জামিনে ছিলেন।
রোববার (২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অজ্ঞানপার্টি চক্রের তৎপরতা দিন দিন বাড়ছে। এসব চক্রের সদস্যদের নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিষক্রিয়ায় অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ও ব্যাংকসহ ব্যস্ততম বিভিন্ন স্থানে সাধারণ যাত্রী বা ব্যাংকে আসা গ্রাহকদের টার্গেট করতো। গত ২ সেপ্টেম্বর কুয়েত প্রবাসী এক ব্যক্তি শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছালে আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা তাকে টার্গেট করে ও ঢাকা থেকে বগুড়া যাওয়ার পথে ওই প্রবাসীকে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুটে নেয়।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী বাদী হয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। বিষয়টি বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচিত হয়। ফলশ্রুতিতে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় এবং বিমানবন্দরসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।
প্রবাসফেরত যাত্রীর ছদ্মবেশে প্রবাসীদের টার্গেট
গ্রেফতাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তারা সংঘবদ্ধ অজ্ঞানপার্টি চক্রের সদস্য। এ চক্রের সদস্য সংখ্যা ৮-১০ জন। তারা বিভিন্ন পেশার আড়ালে গত ১৫ বছর ধরে পারস্পরিক যোগসাজসে রাজধানীর বিমানবন্দর টার্মিনালে ওঁত পেতে থেকে বিদেশফের যাত্রীদের টার্গেট করতো। টার্মিনালে হাতে পাসপোর্ট ও লাগেজ নিয়ে প্রবাসফেরত যাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণ করতো।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, এটি মূলত তাদের একটি কৌশল। পরবর্তী সময়ে এ চক্রটি এমন প্রবাসী যাত্রীদের টার্গেট করতো, যার জন্য অপেক্ষমান কোনো আত্মীয়-স্বজন বা গাড়ি নেই। তারা কৌশলে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে চক্রের অন্য সদস্যদের তাদের কাছের আত্মীয় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতো। পরবর্তী সময়ে ভুক্তভোগীর সঙ্গে একই এলাকার ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতো। চক্রের সদস্যরা সবাই একসঙ্গে বাসের টিকিট কেটে যাত্রা শুরু করতো। ভ্রমণের সময় তারা টার্গেট ব্যক্তিকে কৌশলে চেতনানাশক ওষুধ মিশ্রিত বিস্কুট খাইয়ে অচেতন করতো। ভুক্তভোগী ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে গেলে তার কাছে থাকা যাবতীয় মালামাল নিয়ে চক্রের সদস্যরা কোনো একটি স্টেশনে নেমে যেতো।
বাসের টিকিট কেটে প্রবাসীকে টার্গেট
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, গত ২ সেপ্টেম্বর ভোরে কুয়েত প্রবাসী জনৈক ভুক্তভোগী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। এরপর চক্রটির একজন সদস্য বিমানবন্দর থেকে জনৈক প্রবাসীকে অনুসরণ করতে থাকে। ভুক্তভোগী উত্তরবঙ্গে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আজিমপুর বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছায় এবং উত্তরবঙ্গগামী বাস কাউন্টারে টিকেট কাটতে গেলে কাউন্টারে আগে থেকে প্রবাসী যাত্রীর ছদ্মবেশ নিয়ে থাকা গ্রেফতার আমির হোসেন ভুক্তভোগীকে জানায়, তার কাছে একটি অতিরিক্ত বাসের টিকেট রয়েছে। আগে থেকে সাজিয়ে রাখা একটি লাগেজ ও কিছু কুয়েতি দিনার দেখিয়ে তিনি ভুক্তভোগীকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি (আমির) নিজেও একজন প্রবাসী।
ভুক্তভোগী ব্যক্তি আমির হোসেনকে সরল মনে বিশ্বাসে তার কাছ থেকে টিকেট কিনে পাশের সিটে বসে বগুড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কিছুক্ষণ পরে আমির হোসেন তাকে চেতনানাশক ওষুধ মেশানো বিস্কুট খেতে দেয়। বিস্কুট খাওয়ার কিছুক্ষণ পরে অজ্ঞান হয়ে যায় এবং চক্রটি ভিকটিমের সব মালামাল ও সম্পদ লুট করে নিয়ে পথে নেমে যায়। পরে বাসের সুপারভাইজার ভুক্তভোগীকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেন।
মূলহোতা আমির যেভাবে ১৫ বছর ধরে চক্রের প্রধান
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আমির হোসেন জানায়, সে বিমানবন্দরকেন্দ্রিক একটি অজ্ঞানপার্টি চক্রের মূলহোতা। পড়াশোনা মাধ্যমিক পর্যন্ত। বিমানবন্দর এলাকায় একটি ফাস্টফুডের দোকানে চাকরি করেন। তবে এর আড়ালে গত ১৫ বছর ধরে প্রবাসীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন তিনি। কৌশলে লুটে নিচ্ছেন তাদের সর্বস্ব। এ দীর্ঘ সময়ে প্রায় ৩০০ প্রবাসীকে অজ্ঞান করে তাদের মালামাল লুট করেছেন।
গ্রেফতার লিটনের ভূমিকা
লিটনের পড়াশোনা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। অল্প বয়সের মাইক্রোবাসের চালক বনে যান। তবে এ পেশার আড়ালে গত তিন-চার বছর ধরে তিনি আমিরের অন্যতম সহযোগী হয়ে ওঠেন। এর আগে সে একাধিকবার এ ধরনের মামলায় গ্রেফতার হয়। বিভিন্ন সময় চক্রটি কৌশলে প্রবাসী যাত্রীদের মাইক্রোবাসে পরিবহন করে সর্বস্ব লুট নিতো। তখন মাইক্রোবাসে চালকের ভূমিকায় থাকতো লিটন। এছাড়াও সে বিভিন্ন সময় বিমানবন্দর থেকে যাত্রীদের অনুসরণের কাজ করতো।
গ্রেফতার পারভেজের ভূমিকা
আবু বক্কর ওরফে পারভেজ ৮-৯ বছর বিভিন্ন জুয়েলারি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছে। গত ৬-৭ বছর আগে নিজেই রাজধানীর শ্যামপুরে জুয়েলারি দোকান দেন। তবে এর আড়ালে গত দু-তিন বছর ধরে চক্রটির লুট করা সোনা গ্রহণ, রূপ পরিবর্তন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত ছিল সে।
গ্রেফতার জাকিরের ভূমিকা
জাকির হোসেন ছাপাখানার ঠিকাদার হিসেবে কাজ করে। গত তিন-চার বছর আগে আমিরের মাধ্যমে এ চক্রে তার যোগদান। সে লুট করা সোনার অলঙ্কার ও অন্যান্য মালামাল রাজধানীর বিভিন্ন জুয়েলারি দোকানসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রির সঙ্গে জড়িত ছিল।
জেএন/এও