বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি এমন এক মহামানব, যিনি ছিলেন বাংলা জনসংস্কৃতির অন্যতম বৈশ্বিক প্রচারক। রবিযুগে তখনো সর্বগ্রাসী যান্ত্রিক নাগরিক সভ্যতা বিকশিত হয়নি, রবির সাথে লোকসাহিত্য এবং লোকগীতি নিয়ে জয়নিউজের পাঠক-দর্শকদের জন্য সংক্ষিপ্ত পরিসরে তৎপর হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের কবি ও সংস্কৃতিকর্মী অরিত্রা মুখোপাধ্যায়।
শহর কলকাতার অন্যতম বর্ধিষ্ণু পরিবার হওয়া সত্ত্বেও জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি শিশুদের মাটির কাছাকাছি থাকতে শেখায়। কবির জীবন স্মৃতিরোমন্থন করলে দেখি একের পর এক কঠিন কাজ ও অধ্যবসায়-এর মাধ্যমে ঠাকুর বাড়ির সদস্যদের জীবনের নানান শিক্ষা দেওয়া হয়। বালক রবির উৎসুক দৃষ্টিতে মুগুর ভাজা দেখা থেকে শুরু করে পরিত্যক্ত ধুলোয় পরম আদরে-যত্নে বীজ বপন করে, অঙ্কুরোদগমের প্রতীক্ষা – এ সবই বাঙালির বড় আপন কাহিনী।
এরপর তাঁর জীবনের নানান দিক পরিবর্তন ঘটেছে। ক্রমশ শান্তিনিকেতন পর্বের দিকে তাকালে বুঝি রবিঠাকুরের সাথে মাটির টানকে আলাদা করা অসম্ভব। আজ রবিঠাকুরের সাথে লোকসাহিত্য এবং লোকগীতি’কে খানিক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। ভুল হওয়া টা হয়ত স্বাভাবিক, যেহেতু প্রসঙ্গ নিজেই এক বিশাল বিষয়। নিজ গুণে মার্জনা করবেন। ‘গ্রাম্য সাহিত্য’ নামক প্রবন্ধে গুরুদেব বলেছেন- “দেশের সাধারণ লোকের মধ্যে প্রথমে কতকগুলি ভাব টুকরো টুকরো কাব্য হইয়া চারিদিকে ঝাঁক বাঁধিয়া বেড়ায়। তার পরে একজন কবি সেই টুকরো কাব্য গুলিকে একটা বড় কাব্যের সূত্রে এক করিয়া একটা বড় পিন্ড করিয়া তোলেন।” তাঁর মতে হর পার্বতীর গ্রাম্য কাহিনী গুলিও এই জাতীয় সৃষ্টি , রামায়ণের আগে ‘রামচরিত’ সম্বন্ধে যে গ্রাম্য কথা লোক মুখে প্রচারিত হতো তার প্রসঙ্গ ‘রামায়ণ’ মহাকাব্য গঠনের পর খুব একটা পাওয়া যায় না। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় ‘বাউল ‘ নামে এক অধ্যাত্মবাদী চারণকবি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে ।
যারা মানুষের মন ও তার নানান ভাব নিয়ে গান বাঁধতে থাকে আঞ্চলিক ভাষায়। ১৮৯০ সালে জমিদারি দেখাশোনার কাজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। সে সময় তাঁর পরিচয় হয় সেখানকার বাউলদের সঙ্গে। শিলাইদহের ডাক পিওন গগন হরকরার মুখে কবি শুনলেন- ‘আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যেরে। হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দেশ্যে দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে’- এই সরল ভাষায় উপনিষদের অন্তর দর্শন যেন স্পষ্ট উপলব্ধি করলেন রবীন্দ্রনাথ। বাউল দের প্রেমের সাধনা,মুক্তি,মনের মানুষের সন্ধান,সরল সুরের আবেশে গভীরে পৌঁছে যাওয়া রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি লিখলেন- “দেখেছি একতারা-হাতে চলেছে গানের ধারা বেয়ে মনের মানুষকে সন্ধান করবার গভীর নির্জন পথে। কবি আমি ওদের দলে— আমি ব্রাত্য।” (‘পত্রপুট’ , পনেরো) তাঁর উপন্যাস, গল্প, নৃত্যনাট্য,নাটকে লোকসঙ্গীত এর ব্যবহার দেখেছি বহুবার। তাই তো বাউল তার আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছিল। তার সাহিত্যকর্মের যত্রযত্র সে জন্যই বাউলের উপস্থিতি চোখে পড়ে।
গোরা উপন্যাসে দেখা যায়- কলকাতার রাস্তার ধারে আলখাল্লা পরা বাউল উপস্থিত, তার কণ্ঠে পড়েছি অন্তর ব্যাকুল করা গান- ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায় ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়। ‘প্রায়শ্চিত্ত’নাটকের ধনঞ্জয় বৈরাগী এবং ‘ফাল্গুনী’র অন্ধ বাউল এর কথা এ প্রসঙ্গে প্রযোজ্য। লোকসংগীত সম্পর্কে তাঁর মত খানিক এই রূপ – “…দেশ আপনার বীনায় আপনি সুর বাঁধিয়া আপনার গান ধরিল। প্রকাশ করিবার আনন্দ এত,আবেগ এত যে , তখনকার উন্নত মার্জিত সঙ্গীত থই পাইল না” । আমরা দেখেছি রবি ঠাকুর তাঁর ক্ষ্যাপা বাউলের সুরে ‘আমার একলা নিতাই’ থেকে সৃষ্টি করলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী দের রক্ত প্রবাহে উদ্যমের আগুন জ্বালানোর গান “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে” । আবার “দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা” থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখলেন “ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে”। বাংলাদেশ এর রাজশাহী, কুষ্টিয়া,পাবনা জেলার লোকসঙ্গীত ও সাহিত্য রবীন্দ্রনাথকে প্রবল ভাবে শিকড়ের সন্ধানে ধাবিত করেছিল। কবি ও লোকসাহিত্য নিয়ে যতটুকু বলা যায় ততটাই যেন কম , নিজের স্বল্প জানার পরিসরে যতটুকু পেরেছি ভাগ করে নিলাম। ভুল ত্রুটির জন্য মার্জনা প্রার্থী।
অরিত্রা মুখোপাধ্যায়: পশ্চিমবঙ্গের কবি, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকর্মী।