মিরসরাই। চট্টগ্রাম জেলা সদর থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তরের এলাকা। মুহুরি নদী এই এলাকাকে ফেনী এবং নোয়াখালী জেলা থেকে আলাদা করেছে। ১৬টি ইউনিয়ন ও দু’টি পৌরসভা নিয়ে এই উপজেলা। একে বলা হয় চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার। চট্টলার প্রবেশদ্বার মিরসরাই কি পারবে এই এলাকার যোগ্যসেবককে জাতীয় সংসদে ঠাঁই দিতে? আজ পড়ুন মিরসরাই প্রতিনিধি শারফুদ্দীন কাশ্মীর’র বিশেষ নির্বাচনী প্রতিবেদন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে মাঠে সক্রিয় রয়েছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। বড় দুই দলেই রয়েছে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী। এতে করে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। তারা চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন প্রত্যেক প্রার্থীর বিষয়ে। প্রতিনিয়ত নেতাকর্মীদের সাথে যারা যোগাযোগ রেখেছেন, সুখে-দুঃখে পাশে থেকেছেন এসব বিষয়ও আলোচনায় আসছে। মৌসুমী গণসংযোগকারী সম্পর্কেও হচ্ছে আলোচনা। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে এলাকায় বাড়িয়েছেন জনসংযোগ, পাশাপাশি প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন কেন্দ্রে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি মিরসরাই আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে আগামী নির্বাচনেও নৌকা প্রতীকে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। দলীয় মনোনয়ন দৌড়ে আছেন একাধিক নতুন মুখও। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার আশায় ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছেন অনেকেই। এদিকে আরেক বড় দল বিএনপির প্রার্থীরাও মাঠে নেমেছেন নির্বাচনকে সামনে রেখে। ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে প্রার্থিতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অন্তত অর্ধডজন প্রার্থী। ভোটের লড়াইয়ের আগে দু’দলের মনোনয়ন নিয়ে নবীন-প্রবীণের লড়াই ঘিরে এ আসনে জমে উঠেছে মাঠের রাজনীতি।
সর্বশেষ ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এক লাখ পাঁচ হাজার তিনশ’ ভোট পেয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ধানের শীষের প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী। তিনি পেয়েছিলেন ৯৪ হাজার ৬৬৫ ভোট। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে আবারও লড়াই হবে এই দু’দলের মধ্যেই।
আগামী নির্বাচনে এ আসনের এমপি পদে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন বর্তমান এমপি এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. গিয়াস উদ্দিন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, মন্ত্রীপুত্র মাহবুবুর রহমান রুহেল, তরুণ শিল্পপতি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য নিয়াজ মোর্শেদ এলিট। ১৪ দলীয় প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন চাইতে পারেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়–য়া। মনোনয়ন প্রত্যাশীরা প্রতিনিয়ত এলাকায় জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে।
অন্যদিকে, বিএনপি থেকে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী দলীয় মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রে জোর লবিংয়ের পাশাপাশি এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন। বিএনপি ছাড়াও ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতারাও মনোনয়ন চাইতে পারেন চট্টগ্রামের এই গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় আসনে।
আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নুরুল আমিন, উপজেলা চেয়ারম্যান (সাময়িক বরখাস্তকৃত) নুরুল আমিন, উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা দলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মনিরুল ইসলাম ইউসুফ সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে কাজ করছেন। আবার বিএনপির অনেকে বলছেন এই আসনে বিএনপি থেকে দুই বারের সাবেক সাংসদ ও পরবর্তীতে এলডিপি নেতা এমএ জিন্নাহ্ ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হবেন। বিএনপি জোটের সাথে সমঝোতা হলে মিরসরাইয়ে ২০ দলীয় জোট থেকে প্রার্থী দিতে পারে জামায়াত। এক্ষেত্রে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান প্রার্থী হতে পারেন বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম-১ সংসদীয় আসন হল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ২৭৮নং আসন। মিরসরাই উপজেলা ১৬টি ইউনিয়ন ও দু’টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। মিরসরাইয়ে বর্তমানে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৫৬ জন ভোটার রয়েছেন। এখানে হতে যাচ্ছে এশিয়ার বৃহত্তম শিল্প পার্ক মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল। দেশের লাইফ লাইনখ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রায় ২৯ কিলোমিটার অংশ মিরসরাইয়ের ওপর দিয়ে গেছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচন সামনে রেখে এ আসনে দলীয় কোন্দল, পারস্পরিক অবিশ্বাস দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে দলের অন্যতম চয়েস পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তবে এবার নির্বাচনে দলীয় কোন্দল ফ্যাক্টর হতে পারে জনপ্রিয়, হেভিওয়েট এই প্রার্থীর জন্য। তাঁর পরিবারের একটি ঘনিষ্ট সূত্র জানায়, কোন কারণে যদি তিনি প্রার্থী হতে না পারেন সেক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে তাঁর ছেলে মাহবুবুর রহমান রুহেলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করছেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে বাবার পাশাপাশি সরব উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে রুহেলের।
নির্বাচন প্রসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, মিরসরাইয়ে ইতিমধ্যে ১৮টি পথসভা করেছি। এছাড়াও আরো মিটিং করেছি, করছি যা অন্য কোন আসনে হয়নি। তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ড সমাপ্ত করতে আবার নৌকার ওপর আস্থা রাখবে ভোটাররা। মিরসরাইয়ে দেশের সর্ববৃহৎ ইকোনোমিক জোন হচ্ছে। এখানে উন্নয়নের যে কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটি অব্যাহত রাখতে ইনশাআল্লাহ্ আবার প্রার্থী হবো।
তবে মনোনয়ন নিয়ে বর্তমান এমপিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এবার কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন। তাকে ঘিরে স্থানীয় রাজনীতির একটি বলয়ও তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে যাওয়ায় তিনি পুনরায় আলোচনায় এসেছেন। তার অনুসারীরাও মনে করছেন প্রধানমন্ত্রীর সুনজরে পড়ার কারণেই তিনি সফরসঙ্গী হতে পেরেছেন। আগামী নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রসঙ্গে গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমি তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদ। অতীতে দলীয় সকল আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে প্রথম কাতারে ছিলাম। ওয়ান-ইলেভেনের দুঃসময়েও মাঠ ছাড়িনি। পরবর্তীতে বিএনপির অগ্নি-সন্ত্রাস রাজপথে থেকে মোকাবেলা করেছি। এখনো জনগণের সুখে দুঃখে কাজ করে যাচ্ছি। মনোনয়নের ব্যাপারে দলীয় সভানেত্রীর সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নেবো।
নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পেতে আশাবাদী তরুন মুখ শিল্পপতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ কমিটির সদস্য নিয়াজ মোর্শেদ এলিট। গত কয়েক বছর ধরে এলাকার সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সরব উপস্থিতির মাধ্যমে অনেকের নজর কেড়েছেন তরুণ এ আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি একাধারে চট্টগ্রাম জুনিয়র চেম্বারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, খুলশী ক্লাবের সভাপতি, তরুণ শিল্প উদ্যোক্তা ও ক্রীড়া সংগঠক। নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন প্রসঙ্গে এলিট বলেন, দলীয় সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। দলের কাছে মনোনয়ন চাইবো, দল যদি মনোনয়ন দেয় সেক্ষেত্রে আমি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি। তিনি বলেন, প্রার্থী যেই হোক, দলীয় সভানেত্রীর সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত।
এদিকে, মিরসরাই উপজেলায় বিএনপির রাজনীতিও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে মাঠে নেমেছেন ৫ প্রার্থী। তাদের মধ্যে রয়েছেন ২০০৮ সালে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া ক্লিফটন গ্রুপের এমডি প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরীর সম্ভাবনা বেশি বলে জানা গেছে।
মনোনয়ন প্রসঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য প্রফেসর এমডিএম কামাল উদ্দিন চৌধুরী কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি। মনোনয়ন প্রত্যাশী উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। ৯৬ পরবর্তী হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে যুবদলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে আজ এই পর্যায়ে এসেছি। এক এগারোর জরুরি অবস্থা এবং তার পরের সময়ে দলের সকল কর্মকান্ডে মাঠে রয়েছি। দলের জন্য অর্থনৈতিক অবদান রাখছি। নেতা-কর্মীদের মামলা, হামলায় পাশে রয়েছি। সবকিছু বিবেচনা করলে আমি মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। দেশনেত্রী দল এবং দেশের প্রয়োজনে যে দায়িত্ব দিবেন তার জন্য প্রস্তুত আছি।
মনোনয়নের দৌড়ে আছেন উপজেলা চেয়ারম্যান (সাময়িক বরখাস্তকৃত) ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন। তিনি চেয়ারম্যান আমিন হিসাবে সমধিক পরিচিত। তিনি বলেন, প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, তারপর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। সর্বশেষ জনগণের ভোটে মিরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। সব প্রতিকূলতা পেরিয়েও দলীয় কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। বিগত দুঃসময়ে আন্দোলন সংগ্রামের কারণে একাধিকবার কারাবরণও করতে হয়েছে আমাকে। দলীয় মনোনয়ন পাব বলে আমি আশাবাদী।
উপজেলা বিএনপির আহবায়ক নুরুল আমিন বলেন, ছাত্রজীবন থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রদলের দায়িত্বে ছিলাম। উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সম্পাদক ছিলাম। বর্তমানে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি। দলের জন্য জেল জুলুমের শিকার হয়েছি। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সাথে সব সময় ছিলাম, আছি। তাই দলীয় মনোনয়ন চাইবো। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষে কাজ করবেন বলেও নুরুল আমিন জানান।
বিএনপির আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী বড়তাকিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান, মুক্তিযোদ্ধা দলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মনিরুল ইসলাম ইউসুফ বলেন, দলের জন্য কাজ করেছি, এখনও করছি। মনোনয়ন পেলে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি। তবে দলের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত বলে তিনি জানান।
২০ দলীয় জোট থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান বলেন, দলগতভাবে জামায়াত থেকে আমাকে মনোনীত করা হয়েছে মিরসরাই আসনের জন্য। কিন্তু জামায়াত ২০ দলের শরীক দল। এখানে ২০ দলীয় জোটের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে তিনি মন্তব্য করেন।