চায়ের টেবিল খুব সরগরম। এলাকায় বাজারে, মাঠে, ঘাটে এখন একাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের শুভেচ্ছাসহ বিলবোর্ড, ব্যানারে ছেয়ে গেছে সড়ক থেকে মহাসড়ক।
প্রার্থী বেশি থাকায় এ আসন নিয়ে টেনশনে রয়েছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। এ আসনে মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন বর্তমান সাংসদ আবু রেজা নদভী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, কেন্দ্রীয় উপদপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক অহীদ সিরাজ চৌধুরী স্বপন, বনফুল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ মোতালেব সিআইপি, রুপালী ব্যাংকের পরিচালক ও আওয়ামী লীগ নেতা সাংবাদিক আবু সুফিয়ান, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ নেতা ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মাইনুদ্দিন হাসান চৌধুরী এবং লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খোরশেদ আলম চৌধুরী।
সম্ভাব্য প্রার্থীরা এলাকায় প্রচারণার পাশাপাশি দলের হাইকমান্ডের আস্থা অর্জনে প্রাণান্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সবার মুখে এখন একটাই প্রশ্ন, কে হতে যাচ্ছেন নৌকার মাঝি?
এদিকে আওয়ামী লীগে প্রার্থীর ছড়াছড়ি থাকলেও বিএনপিতে রয়েছে হতাশা। অপরদিকে দ্বন্দ্ব রয়েছে জামায়াতের নেতৃত্বে।
সাতকানিয়ার ১১টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা ও লোহাগাড়ার ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে চট্টগ্রাম-১৫ সংসদীয় আসন। এ আসনে অতীতের ১০টি নির্বাচনে দু’বার আওয়ামী লীগ, তিনবার জামায়াত, তিনবার বিএনপি ও দু’বার জাতীয় পার্টি জয়লাভ করে।
আওয়ামী লীগ: অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘ ৩৫ বছর পর সাংসদ নদভীকে পেয়ে ঝিমিয়ে পড়া রাজনীতিতে নতুন প্রাণ পেয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয় গৃহদাহ। আওয়ামী লীগের সাংসদ ও সংগঠনের মধ্যে সৃষ্টি হয় দূরত্ব। ভোটের মাঠে এ দূরত্ব বড় ফ্যাক্টর হিসেবে দাঁড়াবে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
এ ব্যাপারে লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি খোরশেদ আলম চৌধুরী জয়নিউজকে বলেন, আমি নিজেই মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে কর্মীবান্ধব ও সাংগঠনিকভাবে দক্ষ একজনকে মনোনয়ন দিলে এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হবে বলে আমি মনে করেন।
লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন হিরু বলেন, দীর্ঘদিন ধরে লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সাংসদের বিরোধ চলছে। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিকে দল মনোনয়ন দিলে এ আসনে নৌকা প্রতীক বিজয়ী হতে পারবে।
লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ও ব্যবসায়ী নেতা মামুনুর রশিদ বলেন, আওয়ামী লীগকে এবং এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের অন্তর দিয়ে ভালোবাসেন এমন একজনকে যেন দল মনোনয়ন দেন। আমিনুল ইসলাম আমিন তেমনই একজন নেতা।
লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও লোহাগাড়া সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. নুরুচ্ছফা চৌধুরী বলেন, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগে নদভীর নেতৃত্বে আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি। পাশাপাশি কওমীসহ আলেম সমাজ নদভীকে সমর্থন করে।
লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা এইচ এম গনি সম্রাট বলেন, বর্তমান সাংসদ আবু রেজা নদভী একজন সৎ মানুষ। তিনি কোনো অন্যায় কাজকে প্রশ্রয় দেন না বলে কিছু স্বার্থন্বেষী মহল নদভীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। নদভীকে মনোনয়ন দিলে এ আসনে আওয়ামী লীগের অন্যান্য প্রার্থীর চাইতে ৩০ হাজার ভোট বেশি পাবেন।
লোহাগাড়া উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফজলে এলাহী আরজু বলেন, প্রধানমন্ত্রী নদভীকে নৌকা প্রতীক দিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে আমরা কাজ করছি। দল যাকে মনোনয়ন দিবে দলের স্বার্থে আমরা তার পক্ষে কাজ করবো।
এ ব্যাপারে সাংসদ আবু রেজা নদভী বলেন, আওয়ামী লীগের দলীয় সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন করেছি। নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করেছি। আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মসজিদ-মাদ্রাসা উন্নয়নে এবং কুয়েত ও কাতার পল্লী করে দুস্থদের আবাসনের ব্যবস্থা করেছি।
মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী মন্তব্য করে তিনি বলেন, সংগঠনের বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে।
আমিনুল ইসলাম আমিন জয়নিউজকে বলেন, মনোনয়নের ব্যাপারে আশাবাদী। দলের কোন্দল নির্বাচনে জেতাকে অসম্ভব করে তোলে। সংগঠনে আমার কোনো গ্রুপিং নেই। জন্ম থেকে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকে এখনো তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করছি। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সময় এ এলাকার জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের সময়েও নেতা-কর্মীদের পাশে ছিলাম।
চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক অহীদ সিরাজ চৌধুরী স্বপন বলেন, আমি চট্টগ্রাম শহরে রাজনীতি করলেও আমার রাজনীতির হাতেখড়ি সাতকানিয়ায়। এই কারণে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার আওয়ামী পরিবারের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে।
দলের গ্রুপিং নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, যেহেতু রাজনীতি করি, আমি মনোনয়ন চাইবো। মনোনয়ন পেলে নিজের ক্লিন ইমেজকে কাজে লাগিয়ে দলের গ্রুপিংকে উর্ধ্বে রেখে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে পারবো বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তবে এক্ষেত্রে দলের স্বার্থে দলীয় সভানেত্রী যাকে মনোনয়ন দেবেন তার পক্ষেই কাজ করবো।
এম এ মোতালেব বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নেতা-কর্মীদের সুখে-দুখে পাশে ছিলাম। এছাড়া এলাকার ব্যবসায়ী শ্রেণী আমার সঙ্গে আছেন। মনোনয়ন পেলে এলাকার উন্নয়ন এবং আওয়ামী লীগকে আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা করবো।
বিএনপি: সর্বশেষ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. কর্ণেল অলি আহমদ (বীর বিক্রম) ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন। পরবর্তীতে বিএনপির সঙ্গে মতবিরোধের জেরে ২০০৬ সালে তিনি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) গঠন করেন। তখন এলাকার অধিংকাংশ বিএনপির কর্মী-সমর্থক এলডিপিতে যোগদান করলে বিএনপি কিছুটা নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে।
লোহাগাড়া উপজেলায় আসহাব উদ্দিন চৌধুরী, নাজমুল মোস্তফা আমিন, সাজ্জাদুর রহমান, সেলিম চৌধুরী খোকন এবং সাতকানিয়ায় শেখ মো. মহিউদ্দিন, মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার চেষ্টা চালান।
এ ব্যাপারে লোহাগাড়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি আসহাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আমরা জামায়াতকে ৪০ হাজার ভোটে পরাজিত করে এ আসনে জয়লাভ করি। আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা- এ আসনে বিএনপি থেকে প্রার্থী দেওয়ার।
দক্ষিণ জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক নাজমুল মোস্তফা আমিন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের পাশে ছিলাম। সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছি। দল যদি বিএনপি থেকে চট্টগ্রাম-১৫ আসনে মনোনয়ন দেয় জেতার লক্ষ্যে কাজ করবো। তবে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের প্রতি অনুগত আমি।
এলডিপি: এলডিপির প্রতিষ্ঠাতা ড. কর্ণেল অলির কারণে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় বিপুলসংখ্যক এলডিপির কর্মী-সমর্থক রয়েছে। এ ব্যাপারে লোহাগাড়া উপজেলা এলডিপির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জিয়াউল হক চৌধুরী বাবুল বলেন, কর্ণেল অলি যদি এ আসনে প্রার্থী হন তাহলে বিপুল ভোটে জয়লাভ করবেন।
জামায়াত: সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার এ আসনটি জামায়াতের দূর্গ হিসেবে পরিচিত। ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থী শাহাজাহান চৌধুরী নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে মামলায় জড়িয়ে যাওয়ায় তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। তখন চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমীর আ ন ম শামসুল ইসলাম ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। তবে বর্তমানে জামায়াতের এ দুই নেতা ও কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে বলে জানা যায়।
জামায়াত সমর্থিত লোহাগাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফরিদ উদ্দিন খান জয়নিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম-১৫ আসনে বিএনপি-জামায়াত জোট থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর আ ন ম শামসুল ইসলামকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে জামায়াতের সাবেক সাংসদ শাহজাহান চৌধুরীর অনুসারী লোহাগাড়া আমিরাবাদ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. এনামুল হক বলেন, শাহজাহান চৌধুরীর যে জনপ্রিয়তা সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় রয়েছে সেটাকে কাজে লাগাতে হলে তাঁকে মনোনয়ন দিতে হবে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে।