কলকাতার বুক জুড়ে গঙ্গা। গঙ্গার এক তীর বাগবাজার ঘাট। বাগবাজারে আমার মায়ের বাড়ি। এবার দুর্গাপুজোয় গিয়েছিলাম সেখানে। ষষ্ঠীর ভোর। তখনও আলো ফোটেনি ভাল করে। চারদিকে এক আলো আঁধারি মায়ার খেলা। দিনের এ সময়টা বড় অদ্ভুত। যতদূর চোখ যায় শুধুই অপার শুদ্ধতা। আর একটু পরেই মায়ের বোধন। অনেকদিনের ইচ্ছে মায়ের জন্য হাতে করে কিছু নিয়ে যাই। কিন্তু কি যে নিয়ে যাই ছাই! মন বলে এটা তো মাথা ওটা…বহু ভেবে মন-মাথার ভাবসাব ঘটিয়ে একখানা ডুরেকাটা লালপেড়ে শাড়ি সওদা করেছিলাম আগেই। হোক একঘেয়ে, তবু মাকে আমার এ শাড়িতেই মানায় বেশ। সেখানা হাতে নিয়ে বলা নেই কওয়া নেই সটান হাজির হলাম তাঁর দোরগোড়ায়। দরজা খোলাই ছিল। ঢুকতে যাব চোখে পড়ল দরজার ঠিক উল্টো দিকে এক ফুলওয়ালী। তার আঁচল ভর্তি আধফোটা পদ্ম। এতক্ষণে আলো হয়েছে বেশ। সে আলোয় দেখি একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ অপলক তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। তার দিকে এগিয়ে যেতেই হাতে একটা পদ্ম ধরিয়ে দিল। সেটা নিয়ে এবার ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে ঢুকতেই কী যে হল আমার…এ কটা দিন কী যেন একটা নিয়ে মনটা খারাপ ছিল খুব, হাজার চেষ্টাতেও তা মনে করতে পারলাম না। নিবিড় এক শান্তি কোত্থেকে যেন ঝুপ করে এসে জাপটে ধরল আমায়। এ আমি কী একটু আগের আমি! গতকালের আমি!
মায়ের ঘর দোতলায়। গটগটিয়ে ওপরে উঠতে যাব..আবার থমকালাম। সিঁড়িগুলো একটু উঁচু ধাঁচের। বেশি তাড়াহুড়োয় পুজো পণ্ড হতে পারে। অগত্যা সদ্য প্রেমে পড়া লাজুক মেয়েটির মতো চলতে শুরু করলাম। ঠিক তখনই কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে গেল, ধীরে চলো.. ‘স্লো বাট স্টেডি উইনস দ্যা রেইস’ তা জানো না বুঝি! ..দোতলায় পৌঁছে দেখি তাঁর পুজোর আয়োজন প্রায় সারা। গুটিকয় মানুষ আমার আগেই পৌঁছেছেন। কেউ ইতিউতি চাইছেন, কেউ বা বন্ধ চোখে গভীর ধ্যানে মগ্ন..ভোরের ঘুমটুকু সেরে নিচ্ছেন কিনা কে জানে। ধ্যানমগ্নদের এড়িয়ে এ চোখ গিয়ে পৌঁছল মায়ের শ্রীমুখে। চেয়ে রইলাম আমি, চেয়ে রইলেন তিনি। কতদিন যে এভাবে কেউ দেখেনি আমায় !! সব গ্লানি ধুয়ে মুছে যাচ্ছে যেন। চুপটি করে বসে রইলাম কতক্ষণ তা জানিনা। এভাবে বসে থাকতে পারার জন্যও সাধন চাই, আমার তা কই। উঠে পড়লাম ঝটপট। আমার এক স্বভাব আছে, এমনতর জায়গায় গেলে সেখানকার ঘর বাড়ি সব ছুঁয়ে দেখতে মন চায়। স্বভাব মতোই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম দরজা, জানালা, বারান্দার রেলিং…সব। কে বলতে পারে কখনো মন ভুলে হয়ত এ জায়গাতেই তাঁর হাত পড়েছিল। ঈশ্বরের স্পর্শ..তা কি হাজার বছরেও মলিন হয়!
সময় গড়িয়ে চলেছে..এবার যে ফিরতে হবে। যেমনটা আমাদের সক্কলকে একসময় ফিরতে হয়। যে পথে এসেছিলাম গুটিগুটি এগোলাম সে পথেই। মনের আলসে ঘেঁসে চুঁইয়ে পড়ছে মলিনতা। চোখের জলে ধুয়ে নিচ্ছি নিজেকে।
ফিরতি পথে চোখে পড়ল গঙ্গার ঘাট। শুনেছি এঘাটে তাঁর আনাগোনা হত বেশ, তাই একটিবার না দেখলেই নয়। এগোলাম। কিন্তু খানিকটা এগোতেই একি…এতো ময়লা চারদিকে! বিশ্বস্ত চারপেয়েগণ প্রাতঃকর্ম সেরেছেন যত্রতত্র। তারা না হয় অবলা। সবলাদের রেখে যাওয়া ময়লাও তো নেহাত কম নয়। এত ময়লা এড়িয়ে পথচলা বড় কঠিন হল। তবু চললাম। চলতে চলতে আবারও সেই চেনা স্বর কানে কানে বলে গেল, পথের মধ্যে লোভ, হিংসা, অহং এর মতো কত ময়লাই না চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে; সে সবকে সপাটে না বলে…নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলাই জীবন। কিন্তু কি অদ্ভুত ! গলার স্বরখানা অবিকল যেন আমারই মতো…
ঘাটে পৌঁছে দেখি এয়োতির লাল টিপের মতো সূয্যিখান টুপ করে উঠেছেন সবে। মায়ের ঘাটে দু একজন প্রৌঢ় আর কটা তাজা মনের জমায়েত হয়েছে। কয়েকজন স্নানে নেমেছেন। সূর্যের দিকে মুখ করে ঝপাঝপ জলে ডুব দিচ্ছেন। ওরা কি পাপ ধুয়ে ফেলতে চাইছেন? কি দিয়ে ধুচ্ছেন…সূর্যের নরম আলোয় নাকি গঙ্গার জলে? মনের ভেতরটা কেমন যেন টনটনিয়ে উঠল..এ আমি’র স্নান হয়নি কতকাল।
পৌষালী দে মজুমদার
অলইন্ডিয়া রেডিও কলকাতা
উপস্থাপিকা