গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ ঠিক থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে পোশাক শিল্পখাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিজিএমইএ। গত অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩৫%। চীন থেকে গত কয়েক বছরে অনেক ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে এসেছে। আগামী ৮ বছরে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। চীন যেহেতু পরিবেশগত কারণে টেক্সটাইল থেকে সরে আসছে, ফলে সঙ্গত কারণেই সেগুলো বাংলাদেশে আসবে বলে ধারণা করছে ব্যবসায়ীরা।
আজ সকালে চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এ তথ্য জন্য।
তিনি বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) এর ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের শেয়ার মাত্র ৬.৪০%। এ বাজারেও নিজের শেয়ার আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে বাংলাদেশের। এ সুযোগ গ্রহণের জন্য ও শিল্পের প্রবৃদ্ধি টেকসই করার লক্ষ্যে পোশাকখাতে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, বিশেষ করে নন-কটন এবং বাজার বৈচিত্র্যকরণের উপর জোর প্রয়োজন। উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের সব দেশেই পোশাক রপ্তানি করার পরিকল্পনা করছে ব্যবসায়ীরা।
টেকসই পোশাক শিল্প গড়তে বিজিএমইএ পোশাক শিল্প রূপকল্প ঘোষণা করেছে। এই রূপকল্পের ২০টি লক্ষ্য হলো – কার্বন নিঃসরণ ৩০ শতাংশ কমানো, টেকসই কাঁচামাল ব্যবহার ৫০ শতাংশে উন্নীতকরণ, শোভন কাজের পরিবেশ শতভাগ নিশ্চিত করা, পানির অপচয় ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা, ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার শতভাগে নামিয়ে আনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ২০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া, গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবহার ৩০ শতাংশ হ্রাস, নারী-পুরুষের সমতা শতভাগ নিশ্চিত করা, কর্মসংস্থান ৬০ লাখে উন্নীত করা, উৎপাদনশীলতা ৬০ শতাংশ উন্নীত করা, ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি প্রভৃতি। তবে এই রূপকল্প বাস্তবায়নে অবকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে মানসম্পন্ন অবকাঠামো সরাসরি যুক্ত।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, আইএমএফ এর
পূর্বাভাষ অনুযায়ী বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২২ সালে ৩.২% থেকে ২০২৩ সালে ২.৭% এ হ্রাস পাবে। পাশাপাশি, বিশ্ব বানিজ্যের প্রবৃদ্ধি ২০২২ সালে ৪.৩% থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৩ সালে ২.৫% এ দাঁড়াবে। ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানি সহ প্রধান বাজারগুলোতে প্রবৃদ্ধি যে হ্রাস পাচ্ছে, তা দৃশ্যমান।
তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ সারা বিশ্বেই দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। উন্নত দেশগুলোও কৃচ্ছ্রসাধন করছে। সেসব দেশের মানুষও কমিয়ে দিয়েছে কেনাকাটা। তাই, পোশাকের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। আমরা দেখছি যে আমদানিকরা একসঙ্গে বড় অর্ডার না দিয়ে ছোট স্লটে অর্ডার দিচ্ছে। তারা সহসা অর্ডার বাতিল করছেন, আবার অনেক ক্রেতা ডেফার্ড পেমেন্ট এর দিকে ঝুঁকেছেন। আমাদের জানামতে, এ মুহুর্তে পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করে কারখানা চালানোর মতো কোন অর্ডার কোন কারখানারই কাছে নেই।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, যদিও অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২২ সালে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ৪৫.৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানির নতুন রেকর্ড গড়েছে। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ২৭.৬৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনের কারন হলো কাঁচামালের বাড়তি দামের কারনে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া। অপেক্ষাকৃত উচ্চ মূল্যের পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি। লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, পণ্যের এই মূল্য বৃদ্ধির সুফল উদ্যোক্তারা নিতে পারছেন না। অন্যদিকে, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সবুজ শিল্পায়নে বিপুল বিনিয়োগ করলেও তারা তার যথাযথ মূল্য দিচ্ছেন না।
গত দেড় বছরে সুতার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬২%, কন্টেইনার ভাড়া বেড়েছে ৩৫০%-৪৫০%, ডাইস ও ক্যামিকেলের খরচ বৃদ্ধি ৬০%, গত বছরের শুরুতে মজুরি বৃদ্ধি ৭.৫%, গত ৫ বছরে পোশাক শিল্পে উৎপাদন ব্যয় প্রায় ৪০%-৪৫% বেড়েছে।
কোভিডের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা পরিচালনায় খরচ আরও বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তিন বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ভবিষ্যতে কন্টেইনার ও ফ্রেইট খরচ বাড়ানো ছাড়াও নন কটন পণ্য উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল প্রেট্রোকেমিক্যাল চিপস এর দাম আরও বাড়িয়ে দিবে।
ফারুক হাসান বলেন,এখন ১৮৩টি লিড গ্রিন কারখানা রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ৬০টি প্লাটিনাম রেটেড এবং ১০৯টি গোল্ড রেটেড। আপনারা জেনে খুশি হবেন যে ২০২২ সালে আমাদের ৩০টি কারখানা গ্রিন হয়েছে। কোন একক বছরে এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যক গ্রিন কারখানার সংখ্যা। তবে আমরা এখানেই থেমে যেতে চাই না। বিজিএমইএ প্রতিনিয়ত কাজ করছে পোশাকখাতে গ্রিন কারখানার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য।
তিনি বলেন, পোশাক রপ্তানিকারকদের বৈশ্বিক বাজারে টিকে থাকা এবং পরিবর্তিত বিশ্ব বানিজ্যের প্রেক্ষাপটে পোশাক শিল্পের জন্য যে সুযোগগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলো গ্রহনের জন্য ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াগুলো, বিশেষ করে শুল্ক ও কাষ্টমস সংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলো সহজীকরণ করা জরুরি।
তিনি বলেন, ব্যবসা পরিচালনা সহজীকরনে (ইজ অব ডুয়িং বিজন্যাস) আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। সে জায়গায় উন্নতি করা দরকার। বিশেষ করে ম্যান-মেইড ফাইবারভিত্তিক টেক্সটাইল খাতে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষন করার লক্ষ্যে ব্যবসা সহজীকরণের উদ্যোগ গ্রহন করা জরুরি। লজিষ্টিক সেবা প্রদানে বাংলাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। আমরা মনে করি, ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিতকরণে আমাদের একটি নিজস্ব মানদন্ড থাকা বাঞ্চনীয়। সেইসঙ্গে তা প্রতিনিয়ত নজরদারির আওতায় রাখতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম, রাকিবুল আলম চৌধুরী, পরিচালক আসিফ আশরাফ, মোঃ মহিউদ্দিন রুবেল, মোঃ হাসান (জ্যাকি) ও এম. এহসানুল হক প্রমূখ।
জেএন/এফও/এমআর