তুরস্কে ভূমিকম্পে ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে বাঁচার আকুতি জানিয়ে যাচ্ছে অনেকে। সেই আকুতি কানে এলেও অনেক ক্ষেত্রেই কিছুই করতে পারছে না মুক্ত আকাশের নিচে থাকা স্বজনরা।
ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্ক ও সিরিয়ার বিভিন্ন স্থানের মঙ্গলবারের সাধারণ চিত্র ছিল এটি। তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় হাতায় প্রদেশে ধ্বংসস্তূপের নিচে থাকা এক নারী সাহায্যের আর্তি জানাচ্ছিলেন।
কিন্তু তাঁর আকুতি লোকে শুনতে পারলেও উদ্ধার করা যাচ্ছিল না। দানিজ নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, তারা শব্দ করছে, কিন্তু (উদ্ধারে) কেউ আসছে না।
দানিজ বলেন, ‘আমরা বিধ্বস্ত, আমরা বিধ্বস্ত। হে আল্লাহ…তারা ডাকছে। তারা বলছে ‘আমাদের বাঁচান। ’ কিন্তু আমরা তাদের বাঁচাতে পারছি না। আমরা কিভাবে তাদের বাঁচাব? কোনো উদ্ধারকারী নেই।
একই অবস্থা পাশের আরব দেশ সিরিয়ায়ও দেখা যাচ্ছে। জানদাইরিস শহরের এক ব্যক্তি তাঁর পরিবারের ১২ সদস্যকে হারিয়েছেন ভূমিকম্পে।
আরেকজন জানান, তাঁর কয়েকজন আত্মীয় ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছে। তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। তারা এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু তাদের বের করে আনার কোনো উপায় নেই আমাদের কাছে। তাদের বাঁচানোর মতো এখানে কেউ নেই। কোনো যন্ত্রপাতি নেই।
সিরিয়ায় সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় জরুরি বিভাগের কর্মী, সেনাবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীদের নিয়োগ করা হয়েছে। তার পরও উদ্ধার অভিযানে এসব যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ তুলনায় অনেক উন্নত দেশ তুরস্কেও বিভিন্ন কারণে উদ্ধার অভিযান পরিস্থিতি নাজুক।
প্রচণ্ড শীত, বৃষ্টি ও তুষারের কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। অনেক সড়ক বন্ধ থাকায় উদ্ধারকারীরা সেখানে পৌঁছাতে পারছেন না।
কয়েকটি বিমানবন্দর ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। জীবিতরাও প্রায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেকের বাড়ি অক্ষত থাকলেও পরাঘাতের ভয়ে ঘরে ফিরতে পারছে না।
তুরস্কের অন্যান্য স্থানের মতো আদানা শহরেও সোমবার রাতভর ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে উদ্ধারকাজ চলছিল। জীবিত কাউকে উদ্ধার করা হলে বা মরদেহ পাওয়া গেলে ‘আল্লাহু আকবার’ বলছেন উদ্ধারকর্মীরা।
আদানা শহরের সব মানুষ এখন গৃহহীন। কারো বাড়িঘর ধসে গেছে, আবার অনেকে পরাঘাতের ভয়ে ঘরে ফিরছে না। অনেকের পায়ে জুতা নেই, গায়ে শীতের পোশাক নেই।
মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ আসন্ন দিনগুলোতে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
শিশু রাঘাত বাঁচলেও মারা গেছেন তার গর্ভবতী মা: সিরিয়ায় ভূমিকম্পের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হওয়া ১৮ মাস বয়সী শিশু রাঘাত ইসমাইলের ছবি এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে রাঘাত বাঁচলেও ভূমিকম্পের করুণ শিকার হয়েছেন তার গর্ভবতী মা এবং দুই সহোদর।
সোমবার আজাজ শহরে ধ্বংসস্তূপ থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় রাঘাতকে। আবু হুসাম নামের তার এক আত্মীয় রাঘাতের মা ও সহোদরদের মৃত্যুর তথ্য জানান।
আবু হুসাম বলেন, রাঘাতের বাবা ভেঙে পড়েছেন। তাঁর ছোট মেয়ে অক্ষত আছে। তবে তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী, পাঁচ বছরের মেয়ে এবং চার বছরের ছেলে মারা গেছে।
সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ: তুরস্ক ও সিরিয়ার উদ্ধারকারীরা সময়ের সঙ্গে লড়ছেন বলে মন্তব্য করেছেন ডিউক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রিচার্ড এডওয়ার্ড।
তিনি বলেন, উদ্ধারকারীরা বিভিন্ন কারণে সময় সংকটে আছেন। দুর্যোগের সময় পানি ও অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দৈনিক শরীর থেকে ১.২ লিটার পানি হারায়।
একজন চিকিৎসক বিবিসিকে বলেন, প্রস্রাব, নিঃশ্বাস, জলীয়বাষ্প ও ঘামের মাধ্যমে পানি বেরিয়ে যায়। আট লিটার বা এর চেয়ে বেশি পরিমাণ পানি বেরিয়ে গেলে মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে।
শরীর তাপ বজায় রাখার ক্ষমতা না হারালে প্রাপ্তবয়স্করা ২১ ডিগ্রির নিচের তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। কিন্তু তুরস্কে এখন তীব্র শীত। তাই আটকে পড়া অনেকে অতি ঠাণ্ডার কারণে হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। সূত্র: সিএনএন, এএফপি, বিবিসি
জেএন/পিআর