অনিয়ম ও দুর্নীতির কারখানায় পরিনত হয়েছে চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) একমাত্র গাড়ি সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (পিআইএল)। প্রতিষ্ঠানটির এমডি ও শ্রমিক-কর্মচারী একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ তুলছে।
অভিযোগ লুকাতে এমডি ও শ্রমিক কর্মচারীরা একে অপরকে ঘায়েল করার লড়াইয়ে মেতেছে। চলতি মাসের শুরু থেকে শ্রমিক কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠান থেকে এমডির অপসারণের দাবিতে কারখানার কাজ বন্ধ রেখে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসুচি পালন করেছে।
একইভাবে কর্মসূচি থামাতে এমডির পক্ষ থেকে শ্রমিক কর্মচারীদের সাথে বৈঠকে বসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। শেষ অবধি শীর্ষ ১০ শ্রমিক কর্মচারীকে চাকরি থেকে বহিষ্কারের হুমকি দিয়ে আন্দোলন দমিয়ে রেখেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা।
শ্রমিক লীগের সভাপতি সাজেদুল ইসলাম নিপ্পন বলেন, এমডি তৌহিদুজ্জামান যোগদানের পর থেকে নিয়োগে অস্বচ্ছতা, টেন্ডার ছাড়া মালামাল কেনা, অনুমোদনহীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া, প্রকল্পের কাজ না করেই অর্থব্যয়, সরকারি তেল ব্যবহারে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ উঠে।
এসব অনিয়ম বিভিন্ন সময়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে লিখিতভাবে জানানো হলেও অদ্যাবধি কোনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো নির্বিঘ্নে চলছে সব অনিয়ম। এতে ডুবতে বসেছে পিআইএল। ফলে পিআইএল রক্ষায় এই এমডির অপসারণ দাবি করেন নিপ্পন।
এদিকে পিআইএল ও বাণিজ্যিক অডিট অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরাও নানা অনিয়মের সত্যতা তুলে ধরেছে। বেশ কয়েকটি খাতে এমডির ব্যয় নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছে সরকারের বাণিজ্যিক অডিট অধিদফতর। এরমধ্যে আছে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) লঙ্ঘন করে টেন্ডার ছাড়াই ২২ কোটি ৭০ লাখ টাকার বেশি ব্যয়ে ডাবল কেবিন পিকআপ গাড়ি কেনা।
এছাড়া এমডির নিয়োগ নিয়েও অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়, ২০১১ সালের ৭ মে বিএসইসি মহাব্যবস্থাপক ও উপ-মহাব্যবস্থাপকসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিএসইসি। মহাব্যস্থাপক পদে বয়সসীমা ছিল সর্বনিম্ন ৪৫ বছর।
কিন্তু এই পদে অবেদন করার সময় তৌহিদুজ্জামানের বয়স ছিল ৪৪ বছর। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী যেসব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল সেসবের বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তিনি চাকরির অবেদন করেন। এ পদে চাকরির পরীক্ষায় তিনি পাশ করতে পারেননি।
পরে গোপালগঞ্জের লোক পরিচয়ে অবেদন ছাড়াই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে চাকরি নেন। বিএসইসি চাকরি প্রবিধানমালা অনুযায়ী এই পদে নিয়োগের জন্য বয়সসীমা অনূর্ধ্ব ৪২ বছর। কিন্তু তৌহিদুজ্জামান নিয়োগ পান ৪৪ বছর বয়সে। তিনি মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ২০১৭ সালের ২২ মার্চ। তার নিয়োগটি অবৈধ, তাই তার পদোন্নতিও বৈধ নয়।
সূত্র জানায়, অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক থাকা অবস্থায় ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর তৌহিদুজ্জামানকে প্রগতি টাওয়ার নির্মাণে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির এমডি পদে নিয়োগ পাওয়ার পরও তিনি ৩ বছরের বেশি সময় প্রকল্প পরিচালকের পদ ধরে রাখেন।
কিন্তু প্রকল্পের কোনো কাজ করেননি। একপর্যায়ে কোনো অগ্রগতি ছাড়াই প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। অথচ প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে থাকাকালে প্রকল্পের নানা কাজ দেখিয়ে তিনি প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় করেন। ওই প্রকল্পে কোনো কনসালট্যান্ট না থাকলেও কনসালট্যান্টের নামে ৭৯ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়।
শিল্প প্রতিমন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক পদমর্যদার এক কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, প্রগতির উৎপাদন কাজে ব্যবহারযোগ্য প্রসেস অ্যান্ড অ্যাক্সিলারি ম্যাটারিয়াল কেনার জন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরে টেন্ডারে অকৃতকার্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিম্নমানের মালামাল কেনা হয়েছে।
৯৬ লাখ টাকার এ টেন্ডারে তৌহিদুজ্জামান ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন। টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী জাপানের তৈরি মালামাল সরবরাহ করার কথা থাকলেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে থাইল্যান্ড, ভারত এবং মালয়েশিয়ার তৈরির মালামাল গ্রহণ করেছেন। সরবরাহকারীকে বিধিবহির্ভূতভাবে কয়েক দফায় সরবরাহের মেয়াদ বাড়িয়েছেন তিনি। মালামালের অভাবে কারখানায় কয়েক মাস উৎপাদন বন্ধ থাকলেও সরবরাহকারীকে যথারীতি বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে ওই কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, তৌহিদুজ্জামান চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এবং গোপালগঞ্জে যাতায়াত করেছেন। সরকারি নিয়মে তিনি প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ২০০ লিটার জ্বালানি তেল ব্যবহারের প্রাধিকারভুক্ত। কিন্তু তিনি ব্যবহার করেছেন ৪৫০ লিটার তেল। যেসব তারিখে প্রগতির গাড়িতে ভ্রমণ করেছেন ওইসব তারিখেও ভ্রমণ বিলে তিনি বিমান ভাড়া গ্রহণ করেছেন। সেসব বিষয়ে অডিট আপত্তি রয়েছে সে সবের মধ্যে প্রসেস অ্যান্ড অক্সিলিয়ারি ম্যাটারিয়াল কেনা এবং জ্বালানি তেলের বিষয়ও আছে।
পিআইএল পরিচালক স্বাক্ষরিত ৮ সেপ্টেম্বর শিল্পমন্ত্রীকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তৌহিদুজ্জামান ফৌজদারি মামলার আসামি। দরপত্র ছাড়া পিকআপ চুক্তি করে তিনি ১২ কোটি টাকা আত্নসাৎ করেছেন। প্রগতি টাওয়ার নির্মাণ প্রকল্প থেকে ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এবং গাড়ি উৎপাদন কারখানা উন্নতিকরণের নামে তিন কোটি টাকা আত্নসাৎ করেছেন। তিনি একজন প্রমাণিত দুর্নীতিবাজ। তাই তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তৌহিদুজ্জামানের সীমাহীন দুর্নীতি ও অর্থ আত্নসাতের কারণে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন ছাড়াই তাকে ২০১৭ সালে অবৈধভাবে মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ২০১৬ সাল থেকে ২০ সাল পর্যন্ত প্রকৃত তথ্য গোপন করে এবং পিপিআর লঙ্ঘন করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে ৭১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করেছেন।
শিল্পমন্ত্রীর কাছে দেওয়া পিআইএলর পরিচালক জসিম উদ্দিন রাজিবের এক অভিযোগপত্রে বলা হয়, ডিপিপিতে জিপ গাড়ি কেনার সংস্থান নেই। কিন্তু নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রকল্পের জন্য জিপ গাড়ি ক্রয় ও ব্যবহারে ৭৭ লাখ ২৬ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। এছাড়া কোনো টেন্ডার ছাড়াই নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ডাবল কেবিন পিকআপের ক¤েপানেন্ট সরবরাহ করা হয়। এক্ষেত্রে গাড়িপ্রতি ৩ লাখ ২২ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত মূল্য ধরা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে অবৈধ প্রক্রিয়ায় গাড়ি কেনার কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকার অর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এই অর্থ তৌহিদুজ্জামানের কাছ থেকে আদায় করার প্রস্তাব দেন তিনি।
আরও বলা হয়, বগুড়াতে সার্ভিস সেন্টারের কোনো চাহিদা না থাকলেও সেটি তৈরির নামে সরকারের আট কোটি টাকার বেশি ক্ষতি করেছেন তৌহিদুজ্জামান। ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ করে সেখান থেকে দুই কোটি টাকা আত্নসাৎ করেছেন। একই কায়দায় খুলনাতে সার্ভিস সেন্টার তৈরির নামে ২৫ লাখ টাকা আত্নসাৎ করেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গাড়ির অক্সিলিয়ারি সরঞ্জাম কেনার নামে ৯৬ লাখ টাকা আত্নসাৎ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিআইএলএ এমডি তৌহিদুজ্জামান বলেন, আমি যে পদে আবেদন করেছিলাম সে পদে নিয়োগ পাইনি। কিন্তু এক ধাপ নিচের পদে পেয়েছি-এটা সত্য। কিন্তু বিষয়টি আমার হাতে ছিল না। যথাযথ কর্তৃপক্ষ নিচের পদে যোগ্য বিবেচনা করেই আমাকে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিল। আমি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছি।
অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ওসব নিয়ে পিবিআই, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিএসইসি এবং দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করেছে। এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানা নেই। আর অডিট আপত্তিও ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে নি®পত্তি হয়ে যাবে। এ নিয়ে আমি কোন কথা বলতে চাই না।
অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন অভিযোগ তোলার কে? এসব অভিযোগ তোলার এখতিয়ার তাদের নেই। আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুললে আমার উপরের বসরাই তুলবে। শ্রমিক কর্মচারীদের এসব অভিযোগ আমি কেয়ার করি না। আমি প্রধানমন্ত্রী, সেক্রেটারি ও সচিবের সাথে কথা বলি। শ্রমিকদের সাথে নয়। তাদের সাথে কি আমার যাই? আবার এসব কথা রেকর্ড না করার জন্যও বলেন তিনি।
উল্টো শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে এমডি তৌহিদুজ্জামান বলেন, তারা যে শ্রমিক ইউনিয়ন কর্মচারীর নির্বাচন করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে। আর শ্রমকি কর্মচারী ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠানকে থেকে গাড়ী ব্যবহার, মিলাদুন্নবী ও পিকিনিকের নামে অর্থ লুটপাটের সুবিধা না পেয়ে আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে।
আর এ বিষয়ে জানতে চ্ইালে শ্রমিক লীগের সভাপতি সাজেদুল ইসলাম নিপ্পন বলেন, বর্তমান শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন কোনরকম অনৈতিক সুবিধা নেয় না। এমডির অভিযোগ শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা। এই এমডি একজন দূর্নীতিবাজ। পিআইএল ও বাণিজ্যিক অধিদফতরের অডিট আপত্তিতেও সেটা ফুটে উঠেছে। ফলে প্রতিষ্ঠান রক্ষায় আমরা এই দূর্নীতিবাজ এমডির অপসারণ দাবি করছি। এমডিকে অপসারণ করা না হলে আমরা বৃহত্তর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো।
তিনি আরও বলেন, আন্দোলন দমাতে এই এমডি আমাদের দশ শীর্ষ শ্রমিক নেতাকে চাকরি থেকে বরখাস্তের হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু হুমকি দিয়েও কোন লাভ হবে না। তাকে অপসারণ না করা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। এ বিষয়ে আমরা বিএসইসির চেয়ারম্যান, শিল্পমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
জেএন/এফও/এমআর