দলের হাইকমান্ড থেকে সবসময় জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বলা হতো- দল হিসেবে জামায়াত অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংয়ের উর্ধ্বে, নেতৃত্বের প্রতি লোভ না থাকা দলটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
এভাবে ‘দলীয় আদর্শে অটুট থাকার বুলি আওড়ানো’দলটির চট্টগ্রামের নেতৃত্বে চলছে এখন কোন্দলের অনল। সাতকানিয়া-লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম-১৫) আসনটিতে নির্বাচন কে করবেন- বর্তমান কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর মাওলানা শামসুল ইসলাম নাকি কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য শাহজাহান চৌধুরী তা নিয়েই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে জামায়াত নেতা-কর্মীরা।
দলের ভেতর প্রভাবশালী সাবেক নগর আমির ও বর্তমান কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা শামসুল ইসলাম। বিপরীতে নেতা-কর্মী এবং ওই আসনের ভোটারদের বড় একটি অংশের আগ্রহের কেন্দ্রে দলটির কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য শাহজাহান চৌধুরী।
দলীয় আদর্শ চর্চা নিয়ে কথায় কথায় ‘বড়াই’করা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটির এ দুই আলোচিত নেতা একটি সংসদীয় আসনে নির্বাচন করতে কেন দ্বন্দ্বে জড়ালেন তা নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামের রাজনীতি সচেতনদের মাঝে।
প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে কি জামায়াত নেতারা আদর্শচ্যূত হয়েছেন? পদের প্রতি লোভ কি এখন জামায়াত নেতাদের ওপরও ভর করেছে? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ছলছাতুড়ির আশ্রয় নিয়েছেন দলটির নেতারা।
পরিস্থিতি এমন, এ দুই নেতার দ্বন্দ্ব ভুগিয়েছে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদেরও। কারণ দুই নেতাকে ‘মিলিয়ে’দেওয়ার বৈঠক করতে গিয়ে ঢাকা থেকে একসঙ্গে গ্রেফতার হতে হয়েছে কেন্দ্রীয় জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে।
জয়নিউজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আসনটি নিয়ে দুই নেতার দ্বন্দ্বে জড়ানো, এক নেতার অন্য নেতাকে কোনঠাসা করা, বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম জামায়াত-শিবিরের গ্রুপিংয়ের নেপথ্যের নানা বিষয়।
জানা গেছে, দুই জনের দুইদিকে প্রভাবের প্রতিক্রিয়ায় রীতিমতো প্রকাশ্যে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে জামায়াত-শিবির। অভিযোগ রয়েছে, শামসুল ইসলাম ব্যস্ত ছিলেন কেন্দ্রীয় প্রভাব খাটিয়ে দলের জনবলকে তার দিকে রাখতে। অন্যজন ব্যস্ত ছিলেন দলীয় কর্মসূচির ব্যানারে সাধারণ কর্মীদের ব্যবহার করে নগরজুড়ে অস্থিতিশীলতা ছড়াতে।
জামায়াত ইসলামীর মাঠপর্যায়ে শাহজাহান চৌধুরীর গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা কিছুটা বেশি হলেও কেন্দ্রে শামসুল ইসলামের প্রভাবের কারণে দলের হাইকমান্ডের কাছে শাহজাহানের অবস্থান তলানীতে। শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি শামসুল ইসলাম আরেক সাবেক সভাপতি ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাশেম আলীর বেয়াই। এ কারণেই কেন্দ্রীয় জামায়াতে এই নেতার প্রভাব বেশি। তাই হাইকমান্ড থেকে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় নিজের প্রার্থিতা নিশ্চিত করিয়ে নিয়েছেন সহজেই। মাঠপর্যায়ে দুই নেতা দুই মেরুতে থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘ইচ্ছায়’তাদের সংসার এখন চট্টগ্রাম কারাগারের একই ছাদের নীচে!
জামায়াতের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের পর্যবেক্ষণ হল- কেন্দ্রীয় লবিং খাটিয়ে শাহজাহান চৌধুরীকে স্থানীয় রাজনীতিতে পদহারা করতে পারলেও মাঠছাড়া করতে পারছে না শামসুল ইসলাম। ঠিক এই কারণেই চট্টগ্রামে জামায়াত-শিবিরের পদধারীদের পদ টেকাতে বাধ্য হয়েই শামসুল ইসলামের বন্দনা গাইতে হয়। কিন্তু সাতকানিয়া-লোহাগাড়া এবং চট্টগ্রামজুড়ে জামায়াতের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে ‘অতটা বোঝাপড়া’নেই শামসুলের।
জামায়াতের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, শামসুল ইসলামের ‘কূটচালে’ কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের খড়্গ চেপে ধরেছে শাহজাহান চৌধুরীকে। তাই তাকে নিজ এলাকা ছেড়ে নির্বাচন করতে হবে চট্টগ্রাম-১০ (হালিশহর, খুলশী, পাহাড়তলী ও পাঁচলাইশের একাংশ) আসনে। কিছুটা অভিমান নিয়ে গত এক বছর ধরে এই আসনের মাঠে ‘চাষ’ দিয়েছেন শাহজাহান চৌধুরী। গত ৩ আগস্ট এই আসনের খুলশী থানা এলাকা থেকে শাহজাহান চৌধুরীকে গ্রেফতার হতে হয়।
অভিযোগ রয়েছে, এক সময়ের ছাত্রসংঘ নেতা শাহজাহান চৌধুরীর রাজনৈতিক উত্থানও রক্তাক্ত। ১৯৯১ সাল থেকে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয় তার নেতৃত্বে। কথিত আছে ওই বছর নির্বাচনে যার ‘ম্যাকানিজমে’শাহজাহান চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই প্রকৌশলী আমিনুল ইসলামকেই খুন করে তার ক্যাডাররা। সাতকানিয়ার এঁওচিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নুরুল কবির, মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ কাদেরী, মুক্তিযোদ্ধা মফিজুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা নজির আহমদসহ অসংখ্য হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার অভিযোগ আছে তার ক্যাডারদের বিরুদ্ধে। এছাড়াও জামায়াত ছেড়ে বিএনপিতে যোগদানের অপরাধে আরেক ইউপি চেয়ারম্যান আহমুদুল ইসলাম ও মিনহাজকে র্যাবের ক্রসফায়ারের দেওয়ার ঘটনার পেছনেও তার হাত রয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
অন্যদিকে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে মাঠপর্যায়ে অবস্থান না থাকলেও দলীয় নেতা-কর্মীদের সমর্থন দেখিয়ে নির্বাচন করতে চান শামসুল ইসলাম। কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড থেকে সবুজ সংকেতও নিয়ে রেখেছেন তিনি। দলের নেতা-কর্মীদের একটি অংশের অভিযোগ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জামায়াত ও শিবিরকে ঢাল হিসেবে দেখিয়ে এ আসনে নিজেকে যোগ্য প্রার্থী হিসেবে প্রচারে ব্যস্ত শামসুল ইসলামের অনুসারীরা। দুইজনের দ্বন্দ্বে তৃতীয় কাউকে যেন হাইকমান্ড ঐ আসনে প্রার্থী হিসেবে ভাবতে না পারে সেপথও বন্ধ করে দিয়েছেন শামসুল ইসলাম। কূটকৌশল দিয়ে দলের ভেতর অবস্থান পাকাপোক্ত করলেও শাহজাহান চৌধুরীর ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির দুর্নামের মত কোনো তকমা দলের কেউ লাগাননি শামসুল ইসলামের গায়ে।
জামায়াতের একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও লন্ডন প্রবাসী ব্যারিস্টার হামিদ হোসাইন আজাদকে ঐ আসন থেকে প্রার্থী করার চিন্তা ছিল জামায়াতের। সেই লক্ষ্যে তাকে লন্ডন থেকে নিয়ে এসে এলাকায় গণসংযোগও করিয়েছিল দলটি। কিন্তু অভিযোগ আছে, শামসুল ইসলামের অনুসারীরা তাকে সহযোগিতার পরিবর্তে কোণঠাসা করতে উঠেপড়ে লাগে। এ পরিস্থিতিতে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার শীর্ষ পদে থাকা আজাদ সাতকানিয়া-লোহাগাড়া ত্যাগ করেন।
জামায়াত সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আমির জাফর সাদেককে এই আসনে পরবর্তী নেতা হিসেবে ভাবা হচ্ছিল নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে। তা টের পেয়ে জাফরের অমতে শামসুল ইসলাম তাকে সাতকানিয়া পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচন করান বলে মনে করে জামায়াতের একটা অংশ। নির্বাচনে ‘অপ্রস্তুত’ জাফর অনিবার্যভাবে পরাজিত হন বিএনপির প্রার্থীর কাছে। সেই পরাজয়ের পর জাফরের ওপর থেকে কেন্দ্রের দৃষ্টি সরে যায়। অভিযোগ রয়েছে, পথের কাঁটা সরাতে এভাবেই একে একে কূটকৌশলের আশ্রয় নেন শামসুল ইসলাম।
জানা গেছে, শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি শামসুল ইসলাম এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমির। নেতা-কর্মীদের একটি অংশের অভিযোগ, এ পদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে নিজস্ব একটি বলয় তৈরি করেছেন তিনি। এই গ্রুপিংয়ের পর থেকে জামায়াত-শিবিরের স্থানীয় নেতৃত্ব বিপাকে পড়ে যায়।
এদিকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত শীর্ষ জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর মেয়ের শ্বশুর শামসুল ইসলাম। নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা শামসুল ইসলামকে চট্টগ্রাম জামায়াতের একচ্ছত্র অধিপতি হতে সহায়তা করেছিল বলে জানা যায়। এ সুবাদে তিনি জামায়াতের অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ কর্মকর্তার পদও বাগিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন ঘিরে শামসুল-শাহজাহান দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে নগর জামায়াতের আমির মোহাম্মদ শাহজাহান ৯ অক্টোবর ২০১৭ ঢাকায় শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। সেই বৈঠক থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন জামায়াতের বর্তমান আমির মকবুল আহমেদসহ নয় শীর্ষ নেতা। উল্লেখ্য, নগর জামায়াতের বর্তমান আমির শাহজাহানের বাড়ি কক্সবাজারে। তিনি শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর মোহাম্মদ ইসহাক জয়নিউজকে জানান, জামায়াতে ব্যক্তি পর্যায়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। আমাদের পার্লামেন্ট নির্বাচন নিয়ে আলাদা বোর্ড আছে। সেই বোর্ডের সিদ্ধান্ত হয়েছে ২০০৮ সালের নির্বাচনে যে যেখানে নির্বাচন করেছে এবারও তারা সেখানে নির্বাচন করবেন। দুই নেতার দ্বন্দ্বের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংগঠনের সিদ্ধান্তের বাইরে কোন নেতা-কর্মীর যাওয়ার সুযোগ নেই। নেতাদের মাঝে কোন দ্বন্দ্ব নেই বলেও তিনি দাবি করেন।
জয়নিউজ/জুলফিকার