নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করবে- এ বিষয়টি আগে থেকেই জানতো যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটি। প্রজ্ঞাপন জারির পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেল একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনী ট্রেন যাত্রার আগেই। দলটির চতুর নেতারা তাই কৌশলী হয়েছেন নির্বাচনে নিজেদের অস্তিত্ব জানাতে। দলের নতুন নাম দিয়ে কাজ শুরুর চিন্তা ছিল তাদের। কিন্তু শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্ত এ নির্বাচনে তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে নামাবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী কাজ করবে নাগরিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে।
এদিকে রাজনৈতিকভাবে কোনঠাসা জামায়াত চট্টগ্রামে ৫টি আসনে নির্বাচন করতে চায়। কোথাও বিএনপির দুর্বলতার সুযোগ আবার কোথাও নিজেদের দলীয় প্রভাবকে কাজে লাগাতে প্রার্থী নির্ধারণ করে রেখেছে জামায়াত।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই), চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি), চট্টগ্রাম-১০ (নগরের হালিশহর, খুলশী, পাহাড়তলী ও পাঁচলাইশ আংশিক), চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) ও চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে নজর তাদের।
চট্টগ্রাম-১ আসনে বিএনপির দলীয় কোন্দল মেটাতে ইতিপূর্বে এই আসনে নির্বাচন করতে হয়েছিল স্বয়ং দলীয় চেয়ারপার্সনকে। তার ছেড়ে দেয়া আসনও স্থানীয় বিএনপি ধরে রাখতে পারেনি। এখন যারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী তাদের ব্যাপারেও কেন্দ্রীয় বিএনপি আস্থা রাখতে পারছে না বলে বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চায় জামায়াত। বিএনপির এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে জামায়াত সামনে আনছে সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমানকে। নব্বই দশকের শেষের দিকে সাইফুর রহমান চট্টগ্রাম নগর শিবিরের সভাপতি ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে আইন পেশায় নিয়োজিত থাকা সাইফুর রহমানকে কৌশলী জামায়াত কোন পদে না রাখলেও নির্বাচনী তৎপরতায় সক্রিয় থাকতে নির্দেশ দিয়েছে।
এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, এই আসন থেকে অতীতে উত্তর জেলা জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক মফিজুর রহমানকে মনোনয়ন দেয়া হত। কিন্তু দলীয় পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও এলাকার মানুষের কাছে কার্যকরভাবে তার পৌঁছা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া জামায়াত শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাকে জড়াতে হয়েছে ডজনখানেক মামলায়। এসব মামলায় দীর্ঘদিন জেল খাটতে হয়েছে তাকে। বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে জামায়াতের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। পদে থেকে মামলায় জড়িয়ে দেশ ছাড়তে মফিজুর রহমান বাধ্য হওয়ার পর জামায়াত এ আসন নিয়ে পাল্টেছে তাদের কৌশল। নির্বাচনের জন্য তারা বাছাই করেছে দলীয় পদহীন একজন পেশাজীবীকে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের এই কৌশল ধোপে টিকবে কী না তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছু দিন।
চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসন নিয়ে বিএনপিতে কোন্দল চরমে। এই আসনে বিএনপির সর্বশেষ বিজয়ী প্রার্থী যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ২০০৮ সালে স্থানীয় বিএনপির শক্ত কোন প্রার্থী না থাকায় জামায়াতের সহযোগিতায় রাঙ্গুনিয়া থেকে ফটিকছড়ি গিয়ে তিনি নির্বাচন করেছিলেন। এর আগে বিএনপির প্রার্থী হয়ে সর্বশেষ ১৯৯১-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী।
বর্তমানে বিএনপির হয়ে প্রার্থী হওয়ার জন্য ফটিকছড়ি আসনে প্রভাবশালী কোন নেতাকে মাঠে দেখা যায়নি। এবার তাই বিএনপির ‘নেতৃত্বশূন্যতার’ সুযোগ নিতে চায় জামায়াত। এই আসনে তাই তারা প্রার্থী ঠিক করেছে। চট্টগ্রাম নগর জামায়াতের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী অধ্যক্ষ নুরুল আমিন চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তও নিয়েছে তারা। নুরুল আমিন চৌধুরী আশির দশকের শেষের দিকে নগর শিবিরের সভাপতি ছিলেন।
দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ফটিকছড়ির রাজনীতিতে প্রভাব রয়েছে তার। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে আগে থেকে পরিকল্পনা ছিল বলে দলীয় কর্মসূচিতে জামায়াত তাকে খুব বেশি সামনে নিয়ে আসেনি। ফলে তার বিরুদ্ধে খুব বেশি মামলা নেই। তবে দল হিসেবে জামায়াতের প্রতি ওই এলাকার ভোটারদের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। কারণ ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল সংঘটিত ভূজপুর হত্যাকাণ্ডে জামায়াত ক্যাডারদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। তাই প্রার্থী অথবা প্রতীক বিবেচনার চেয়ে দল হিসেবে জামায়াতের প্রার্থীকে ওই এলাকার ভোটাররা কতটুকু গ্রহণ করবে তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচন পর্যন্ত।
চট্টগ্রাম-১০ (হালিশহর, খুলশী, পাহাড়তলী ও পাঁচলাইশ আংশিক) আসনের দিকেও নজর জামায়াতের। সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার দ্বন্দ্ব নিরসনে তাদের টার্গেট এই আসন। সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় আ ন ম শামসুল ইসলামকে আর শাহজাহান চৌধুরীকে নগরের এই আসনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানোর পরিকল্পনা রয়েছে জামায়াতের। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত এই এলাকায় জনসংযোগে সক্রিয় ছিলেন শাহজাহান চৌধুরী।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে জামায়াতের হয়ে আ ন ম শামসুল ইসলামের নির্বাচন করার কথা রয়েছে। তিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতের ব্যানারে নির্বাচিত হয়েছিলেন। শামসুল ইসলাম শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি। বর্তমানে তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির নায়েবে আমীর। এর আগে তিনি এক যুগেরও বেশি সময় চট্টগ্রাম নগর জামায়াতের আমীর ছিলেন। তবে এই আসনে জামায়াতই জামায়াতের শত্রু। কারণ অতীতে এ আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন শাহজাহান চৌধুরী। দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি মামলায় জড়িয়ে তিনি নির্বাচনে প্রার্থীতার অযোগ্য ছিলেন। যদিও সেই মামলা থেকে উচ্চ আদালত তাকে খালাস দেয়। শাহজাহান চৌধুরীর অনুসারী ও জামায়াতের অধিকাংশ কর্মী-সমর্থক এ আসনে পুনরায় তাকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চায়। এ নিয়ে দুই নেতার অনুসারীদের বিবাদ প্রকাশ্য। তাই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে ঘরের শত্রুদেরও সামলাতে হতে শামসুল ইসলামকে।
চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা জহিরুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি বাঁশখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। জামায়াত নেতা হিসেবে তার যতটুকু শক্ত অবস্থান রয়েছে, তার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা শেখেরখীল ইউনিয়নের বাসিন্দা ও পীর মাওলানা ইসহাকের ছেলে হিসেবে। ‘ধর্মপ্রাণ’ ভোটারদের কাছে টানতে পীরের সন্তান হিসেবে জহিরুল পেয়ে থাকেন বিশেষ সুবিধা। তবে জাতীয় নির্বাচনে ভোটের সমীকরণে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দল জামায়াতের নেতা হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যান জহিরুল তার নামের পাশে সংসদ সদস্য লিখতে পারছেন কী না তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচন পর্যন্ত। বর্তমানে তিনি নাগরিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে গণসংযোগ করছেন এলাকায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর মোহাম্মদ ইসহাক জয়নিউজকে বলেন, স্থানীয় ও মাঠপর্যায়ের পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থী নির্ধারণ করেছে জামায়াত। স্থানীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে একেক এলাকায় একেক সংগঠনের নামে ভোটের মাঠে যাবে দল। জামায়াত পাঁচটি আসনে নির্বাচন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ পাঁচটি আসন হল চট্টগ্রাম নগরে একটি, উত্তর জেলা ও দক্ষিণ জেলায় দুটি করে। নির্বাচনী হাওয়া ও জোটগত সিদ্ধান্তের উপর সবকিছু নির্ভর করছে।
জয়নিউজ/জুলফিকার