চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতির পরিসংখ্যানগত পর্যালোচনা প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
আজ সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে ১১৯ জন সাংবাদিক নানাভাবে নির্যাতন, হয়রানি, মামলা, হুমকি ও বাধার শিকার হয়েছেন।
একই সময়ে ১৭৯টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৪ জন নিহত হয়েছেন বলেও জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনটি।
দেশের ১০টি জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদ ও আসক সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
আসক জানায়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন। জানুয়ারি থেকে জুন এই ৬ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ছিল উদ্বেগজনক।
এ ছাড়া বেআইনি আটকের অভিযোগ ও রহস্যজনক নিখোঁজ, সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়ন, সীমান্তে হত্যা, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে।
সোমবার প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৬ মাসে ঢাকায় সর্বাধিক ২৯ জন এবং চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় ৮ জন করে সাংবাদিককে হয়রানি ও নির্যাতন করা হয়েছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বরাত দিয়ে আসক জানায়, ৬ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২৪টি মামলার মোট আসামি হয়েছেন ৬০ জন। এর মধ্যে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৬ জন। এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ৪ জন এবং গুলিতে ২ জনসহ মোট ৬ জন মারা গেছেন।
এরমধ্যে র্যাব হেফাজতে নওগাঁয় সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনাকে বিদ্যমান আইন ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার অন্যতম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ ছাড়া একই সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ১৭৯টি। এতে নিহত হয়েছেন ১৪ জন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ২ হাজার ৪২২ জন।
এরমধ্যে নরসিংদীতে ৩ জন নিহত, ঢাকায় ৭টি ঘটনায় ১৯২ জন আহত এবং বরিশালে ১০টি ঘটনায় ১৩৯ জন আহত হয়েছেন।
আসকের প্রতিবেদন বলছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদসূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ছয় মাসে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে ২৪টি মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৬০। এর মধ্যে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার হয়েছে ২৬ জন। এই ২৪টি মামলার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার দায়ে ৫টি মামলা রয়েছে, যেখানে আসামি করা হয়েছে ৫ জনকে এবং তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪ জনকে।
সাংবাদিক ও মুক্তচিন্তা চর্চাকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলাগুলো প্রত্যাহার ও আইন বাতিলের জোর দাবি জানিয়েছে আসক।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে এ সময়ে কমপক্ষে ১০ জন বাংলাদেশির মৃত্যু ঘটেছে এবং ১৪ জন আহত হয়েছে।
বছরের এ সময়ে ৫টি ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩টি বাড়িঘরসহ ১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দুর্বৃত্তদের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ১৫টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় এই সম্প্রদায়ের ১ জন নিহত ও কমপক্ষে ৬২ জন আহত হয়েছে।
গত ছয় মাসে যৌন হয়রানি কেন্দ্রিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৫৪ জন নারী-পুরুষ, যাদের মধ্যে হামলার শিকার হয়েছেন ৭৯ জন নারী ও ৭৫ জন পুরুষ। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ২৯৪ নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২০ জন নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন নারী।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের প্রায় সবকটি জেলায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সর্বাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ঢাকায় ২৭ টি।
দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ছয় মাসে মোট ৮০৪টি শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ১০৯টি শিশু এবং ১ জন ছেলেশিশুকে বলাৎকারের পর হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ৪৫ শিশু, বিভিন্ন সময়ে মোট ৮৭ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
ছয় মাসে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৫১ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৪ জন এবং হাজতি ২৭ জন। গত ছয় মাসে দেশে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন মোট ২৪ জন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ঢাকা বিভাগে—১২ জন।
আসক মনে করে, মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে আইনের শাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যকীয়। অন্যথায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
জেএন/পিআর