মিয়ানমারের টালবাহানা আর রোহিঙ্গাদের শর্তের গ্যাঁড়াকলে আটকে আছে প্রত্যাবাসন। বাংলদেশে রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর পার হতে চললেও প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।
শুধুমাত্র ক্যাম্প পরিদর্শন ও রোহিঙ্গাদের আশ্বস্ত করেই দায় সারছেন বিদেশি প্রতিনিধিরা। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সহায়তাও কমছে আশঙ্কাজনক হারে। যার কারণে নানামুখী সংকটসহ অস্থিরতা বাড়ছে কক্সবাজার অঞ্চলে।
আর গেলো ছয় বছরে ক্যাম্পে নতুন করে জন্ম নিয়েছে এক লাখ ৮০ হাজার শিশু। এমন বাস্তবতায় রোহিঙ্গাদের এ দেশে আশ্রয় নেওয়ার ছয় বছর পূর্ণ হলো আজ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নির্যাতনে বরাবরই রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশমুখী ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে বিভিন্ন সময়ে কয়েক লাখ নিপীড়িত রোহিঙ্গা এদেশে এসে বসবাস করছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের নজিরবিহীন ঢল নেমেছিল। রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্যাতন শুরু করলে সীমান্ত দিয়ে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। সব মিলিয়ে এদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়ায়।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা-ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৯ লাখ ৬২ হাজার ৪১৬ জন রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদের মধ্যে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে ৯ লাখ ৩১ হাজার ৯৬০ এবং ভাসানচরে ৩০ হাজার ৪৫৬ রোহিঙ্গা বাস করছে।
মানবিক কারণে বিপুলসংখ্যক এ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ। তবে গত ছয় বছরে বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি; বরং দিন দিন তারা বাংলাদেশের ওপর অনেক বড় বোঝা ও সংকট হয়ে চেপে বসেছে। পাশাপাশি বিশ্ব সম্প্রদায়ও রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে।
ইউএনএইচসিআর বলছে, রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাংলাদেশিসহ প্রায় ১০ লাখ ৪৭ হাজার মানুষকে সহায়তা করতে মানবিক সংস্থাগুলো এ বছর ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারের আবেদন করেছে।
২০২৩ সালের আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনার জন্য তহবিলে আবেদনের মাত্র ২৮ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছেছে। এর প্রভাব পড়েছে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তার ওপর। ফলে ক্রমবর্ধমান অপুষ্টি, শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়া, বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রম এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাও বাড়ছে।
সংস্থাটি বলছে, ২০২৩ সালেও রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রাপ্ত তহবিল সহায়তায় বরাবরের মতো সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় কমিশন, জাপান, জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ।
আশ্রিত রোহিঙ্গাদের টেকসই মানবিক সেবা নিশ্চিতে আর্থিক সাহায্য নিশ্চিত এবং তাদের সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবারও রাজনৈতিক সহায়তা চেয়েছে ইউএনএইচসিআর।
রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল কমে আসার কথা স্বীকার করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গা খরচের পুরোপুরি দায়িত্ব জাতিসংঘের। বাংলাদেশের কোনো দায়িত্ব নেই। এর পরও রোহিঙ্গাদের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যয় করছে বাংলাদেশ সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব সত্ত্বেও দ্বিপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় কোনো তৎপরতাই একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারেনি।
এমনকি চীনের উদ্যোগে পাইলট প্রকল্পও কবে বাস্তবায়ন হবে, তা নিশ্চিত নয়। এমন দীর্ঘসূত্রতা আন্তর্জাতিক মনোযোগ হারানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
২০১৭ সালে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ‘ঢেউ’ নামলে বাংলাদেশ সংকট সমাধানে চীনের ওপর ভরসা করে। কারণ মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক রয়েছে।
সংকট সুরাহায় চীনের মধ্যস্থতায় তিন ধাপ কর্মসূচির আওতায় ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয় এবং ১৯ ডিসেম্বর ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠিত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১ হাজার ১৪০ রোহিঙ্গাকে পাইলট প্রত্যাবাসনের জন্য বাছাই ও মিয়ানমার ঘুরিয়ে আনা হয়। এরপর মোখা, বন্যাসহ নানা অজুহাতে পাইলট প্রত্যাবাসনও থেমে আছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ক্যাম্পের মধ্যে প্রত্যাবাসনবিরোধী প্রচারণার কারণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরতে চায় না। এ ছাড়া তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের বিষয়টিও তাদের এখান থেকে যেতে প্রলোভনের ফাঁদ হিসেবে কাজ করছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ সূত্রগুলো জানিয়েছে, তৃতীয় দেশে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের সংখ্যা অত্যন্ত নগন্য। ২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মাত্র ৯২০ রোহিঙ্গা তৃতীয় দেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ২০২২ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ জন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা গেছে।
জাপান মাত্র ৪ জনকে উচ্চ শিক্ষার জন্য নিয়েছে। তা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা মনে করে, তারা এদেশ থেকে উন্নত দেশগুলোতে যাওয়ার সুযোগ পাবে। ২০১২ সালের পর অনেকেই এই আশায় মিয়ানমারে ফেরেনি।
এবারও তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে একদিকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে ক্যাম্পের মধ্যে খুন, গ্রুপিং, আধিপত্যের লড়াই, অস্ত্র চোরাচালানের মতো ঘটনা বাড়ছে। এ ছাড়াও অলস দিনযাপন এবং জন্মনিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত না হওয়ায় বেড়েই চলেছে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের আগের ঘরবাড়ি নেই, তবে অন্য ধরনের সুবিধা রয়েছে। সেখানে গিয়ে কিছুদিন না থাকলে সমস্যাগুলো চিহ্নিত হবে না। ফলে রোহিঙ্গাদের পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসনে বাধা হয়ে দাঁড়ানো কারও উচিত নয়।
বেশির ভাগ রোহিঙ্গা ফেরত যাওয়ার পক্ষে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এ পর্যন্ত বিশ্বনেতাসহ বহির্বিশ্বের প্রতিনিধিদেরও রোহিঙ্গারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলেছেন, তারা রাখাইনে ফেরত যেতে চায়। তবে মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাবে প্রত্যাবাসন হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার আলোকে ক্যাম্পের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গণমাধ্যম যতটা সোচ্চার, ততটা তাদের মানবিক সহায়তা ও প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে দেখা যায় না। এটা নিঃসন্দেহে বিশ্ব সম্প্রদায়ের অবহেলা ও স্ববিরোধী আচরণ।
এদিকে দীর্ঘায়িত রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে বাংলাদেশ সরকারের চ্যালেঞ্জ ক্রমাগত বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সক্রিয় সন্ত্রাসী গ্রুপের সংখ্যা বাড়ছে।
হত্যা, অপহরণ, সহিংসতা, সন্ত্রাস, মাদক ও অস্ত্র পাচারের পাশাপাশি আধিপত্যের লড়াইয়ের কারণে প্রায়ই সেখানে রক্ত ঝরছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে আড়াই হাজারের বেশি মামলা হয়েছে।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) আড়াই হাজার সদস্য দিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমনকি ভাসানচরের মতো নিরাপদ স্থানেও পারিবারিক দ্বন্দ্বে রোহিঙ্গা খুনের ঘটনা ঘটেছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয় দেওয়া মানবিক বাংলাদেশকে সহায়তা করার দায়িত্ব জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের। তারা যেন কোনোক্রমেই রোহিঙ্গা সংকটকে গুরুত্ব কম না দেয়, সেজন্য প্রথাগত কূটনৈতিক যোগাযোগের বাইরে বহুমুখী কূটনৈতিক তাগিদও জোরদার করা জরুরি।
জেএন/পিআর