চট্টগ্রামসহ গোটা বাংলাদেশেই ক্ষনে ক্ষনে আবহাওয়া মেঘলা হওয়ার দরুন পুবালি বাতাসের সঙ্গে কখনও ইলশেগুঁড়ি কখনও বা নামছে ঝুমবৃষ্টি। বর্ষার চিরচেনা এই পরিবেশ নদনদীতে বেশি বেশি ইলিশ পাওয়ার পুরোপুরি উপযোগী।
প্রতি বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে দেশে ইলিশের প্রচুর জোগান থাকে। ফলে বাজারে দামও কম থাকে। সারা বছর ইলিশের দাম নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে থাকলেও এ সময়ে তা সাধ্যের মধ্যে চলে আসে।
তবে বাজারে বলতে গেলে এখন ইলিশের আকাল চলছে। ইলিশের জোগান না থাকায় চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় বাজারের মাছ ব্যবসায়ীরা হাত গুটিয়ে বসে থাকছেন। সাগরের যে অল্প কিছু ইলিশ আসছে, তার দামও আকাশছোঁয়া। অন্যদিকে বাজারে খাল-বিলের দেশি মাছের সরবরাহও কম থাকায় ইলিশের দাম আরো বেড়েছে।
আরো পড়ুন : মাছঘাট বাজারে ইলিশের আকাল, কমছে না দাম
জাতীয় এ মাছটি এখন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। আর নিম্নবিত্তরা ইলিশের কথা চিন্তাও করতে পারছে না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন কারণে এবার ইলিশের আকাল চলছে।
- প্রথমত ইলিশ ঝাঁক ধরে চলাফেরা করে। তারা ডিম দেওয়ার জন্যই সাধারণত নদীতে আসে। কিন্তু নদীর মোহনায় অনেক বেশি চর পড়ায় ইলিশের ঝাঁক ঢুকতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে ইলিশ নদীতে না ঢুকে সাগরেই ফিরে যাচ্ছে।
- দ্বিতীয়ত নদীদূষণ। এখন আমাদের নদীর পানি নানা দূষণে আক্রান্ত। কলকারখানাসহ নানা ধরনের বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পলিথিনসহ নানা অপচনশীল দ্রব্যাদি নদীর পানিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু ইলিশ মাছ অত্যন্ত সংবেদনশীল। তারা দূষিত নদীতে আসতে চায় না।
- তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে আমাদের দেশেও। এর ফলে পানির লবণাক্ততা বাড়ছে। উষ্ণ হচ্ছে তাপমাত্রা। যার ফলে ইলিশের প্রজনন মৌসুমও পরিবর্তন হচ্ছে। এতে আগে জুলাই মাস থেকে ইলিশ ধরা পড়লেও এখন আর এই সময়ে মাছ নদীতেই আসছে না।
মৎস্য অধিদপ্তরের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, গত ১ জুলাই থেকে ইলিশ ধরার মৌসুম শুরু হয়েছে। জাল, ট্রলার নিয়ে নিয়মিত নদী ও সাগরেও গেছেন জেলেরা। অথচ তাঁরা ফিরেছেন প্রায় খালি ভাঁড়ার নিয়ে।
কারণ, এই ভরা মৌসুমেও নদীতে মিলেনি জলের রুপালি শস্য ইলিশ। ফলে বাজারে ইলিশ সংকট রয়ে গেছে। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রগুলোতেও হাঁকডাক কম। বিমর্ষ মৎস্য শ্রমিকদের দিনের বেশিরভাগ সময় কাটছে অলসভাবে।
আরো পড়ুন : ছোট-বড় ইলিশের দেখা মিললেও দাম নাগালের বাইরে
তবে আজ শুক্রবার বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে দাবী করছেন ‘ইলিশের মৌসুম কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তাই এখনই বলা যাচ্ছে না, ইলিশ কম।
তবে এ বছর রেইনফল দেরিতে হয়েছে। এর কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বলা যায়। মাছও দেরিতে ধরা পড়তে শুরু হয়েছে।
এখন কিন্তু ধীরে ধীরে মাছ আসছে। হয়তো এমনও হতে পারে, মা ইলিশ সংরক্ষণের সময় অক্টোবরের আগে বা পরে বেশি পরিমাণে মাছ ধরা পড়তে পারে।
মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, সাগরে নদী থেকে মিঠাপানির একটা স্রোত থাকে। এ বছর মিঠাপানির এ প্রবাহ অনেক কম। পানির এই প্রবাহ না থাকলে ইলিশের ঝাঁক আসতে উৎসাহিত হয় না। এ জন্য এই বছর ইলিশের পরিমাণ অনেক কম। তবে চলতি মৌসুমে ইলিশের আরও তিনটি জো (মাছ ধরার উপযুক্ত সময়) আছে। এই তিন জোতে ইলিশের পরিমাণ বাড়তে পারে।
তবে নদীতে বেশি ইলিশ ধরা না পড়লেও সাগরে মোটামুটি ধরা পড়ছে। কিন্তু নদীর ইলিশ সুস্বাদু হওয়ায় ভোক্তাদের কাছে এ ইলিশের চাহিদা বেশি। চাহিদার কারণে অনেক মাছ ব্যবসায়ীই সাগরের ইলিশকে নদীর বলে চড়া দাম হাঁকছেন।
আরো পড়ুন : সোয়া দুই কেজির ইলিশ ৯ হাজারে বিক্রি!
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর ফিশারিঘাটে দেখা যায়, মোকামগুলো প্রায় ইলিশশূন্য। যতটুকু ইলিশ উঠছে, তার দাম অত্যধিক। এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১৫০০ টাকায়। ৬শ থেকে ৯শ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি হাজারের ওপর। ৫শ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজিও ৬শ টাকার কমে মিলছে না। ৩শ থেকে ৪শ গ্রামের ইলিশের কেজিও প্রায় ৫শ টাকা। যা অন্যান্য বছরের এ সময় দাম থাকে অর্ধেক মূল্যে।
বাজারের ইলিশ আড়তদার রহমত উল্লাহ জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানে ২০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। মাছের আমদানি না থাকায় শ্রমিকদের আসতে নিষেধ করেছেন। তাঁদের কেউ এখন রিকশা চালান, কেউ ভ্যানগাড়িতে সবজি বিক্রি করেন।
বাজারের ক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া মাছের কেন এত দাম হবে? এ মাছে চাষের খরচ নেই। নেই ফিড বা মেডিসিনের। তার পরও নদী বা সমুদ্র থেকে জাল টেনে ধরে আনা ইলিশের দাম মাংস থেকেও অনেক বেশি।
মাছ ব্যবসায়ীদের দাবি, একটি ট্রলার পাঠাতে অনেক খরচ। জ্বালানি তেলের দাম বেশি। একটি ট্রিপে যে খরচ হয়, সে তুলনায় ইলিশই পাওয়া যায় না। ফলে দাম কমছে না।
তবে দু’এক সময় কোনো ট্রলারে হয়তো অনেক বেশি মাছ পাওয়া যায়। যদি কোনো ইলিশের ঝাঁক একবারে জালের নিচে পড়ে, তাহলেই হয়তো লাভের মুখ দেখা যায়। কিন্তু সেটা সার্বিক চিত্র না। আর তা দিয়ে বাজারে দাম কমে না।
মৎস্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, বছরে মোট ইলিশ আহরণের তিন ভাগের দুই ভাগেরও বেশি মাছ পাওয়া যাবে এই সময়ের মধ্যে। এ বছর নদীতে খুব কম ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। তবে চলতি মাসে সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। ওই সময় মোকামগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ ইলিশ আসে। জেলেরাসহ আমরা সবাই সুসময়ের অপেক্ষায় আছি।
জেএন/পিআর