লিবিয়ায় ভয়াবহ বন্যার পর দেশটির ভূমধ্যসাগরীয় শহর দেরনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫,২০০ জন। দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ তথ্য দিয়েছে।
লিবিয়ার বিধ্বস্ত পূর্বাঞ্চলীয় শহর দেরনায় পুনরুদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকায় এ মৃতের সংখ্যা বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ওই শহরটিতে উদ্ধারকারী এবং ত্রাণবাহী গাড়ির বহরগুলো যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু, সেখানে যাওয়ার জন্য শুধুমাত্র একটি কার্যকরী রাস্তা বাকি রয়েছে।
দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ১০০০টিরও বেশি লাশ সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭০০ জনকে দাফন করা হয়েছে।
দেরনা শহরের দুটি বাঁধ ও চারটি সেতু ধ্বসে গেছে এবং এর ফলে রোববার ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলে ভেসে গেছে শহরের বড় একটি অংশ।
রেড ক্রিসেন্ট বলছে, প্রায় ১০ হাজার মানুষ এখনও নিখোঁজ আছে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও আরও বাড়তে পারে।
কিছু উদ্ধার তৎপরতা সেখানে শুরু হয়েছে, যাতে এগিয়ে এসেছে মিসর। তবে লিবিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এ তৎপরতা কিছু বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশটি এখন দু’টি সরকারের নিয়ন্ত্রণে বিভক্ত হয়ে আছে।
যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইরান, ইটালি, কাতার এবং তুরস্কসহ কিছু দেশ জানিয়েছে প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে তারাও প্রস্তুত আছে।
এর মধ্যে মাত্র আগের দিন মরক্কোর মধ্যাঞ্চলে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে দুই হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে বলে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানিয়েছে মরক্কোর রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন।
পানিতে ভেসে যাচ্ছে গাড়ি
লিবিয়ায় রোববার অন্ধকারের মধ্যেই করা ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে শহরের রাস্তায় বন্যার পানিতে ভেসে যাচ্ছে বহু গাড়ি।
অনেক মানুষের সাগরের পানিতে ভেসে যাওয়ার কষ্টকর ঘটনার পাশাপাশি অনেকে আবার নিজেকে রক্ষার জন্য অবস্থান নিয়েছেন নিজ নিজ বাসা বাড়ির ছাদে।
লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে নিয়ন্ত্রিত সরকারের হয়ে বলছিলেন হিশাম চোকিওয়াত, “যা দেখেছি তাতে আমি হতবাক। এটা ছিলো সুনামির মতো।”
তিনি জানিয়েছেন, দেরনা শহরের দক্ষিণে একটি বাঁধ ধ্বসে যাওয়ায় শহরের বড় অংশ সাগরের পানিতে তলিয়ে গেছে।
“একটি বড় এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর সংখ্যা প্রতি ঘণ্টায় বাড়ছে”।
আলি দেবিয়াহ নামে একজন বলছিলেন, মৃতদেহ উদ্ধারেও হিমশিম খেতে হচ্ছে উদ্ধারকারীদের। তবে নৌ-বাহিনী ও ডুবুরিরা সাগর থেকে লাশগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করছে।
বায়দা শহরের সাহায্যকর্মী কাসিম আল কাতানি বলেছেন, শহরের প্রধান সড়কগুলো ব্যাপক ক্ষতির শিকার হওয়ায় উদ্ধারকারীদের ডেরনা শহরে পৌঁছানোটাই কঠিন ছিল।
তবে, কেন বন্যায় এমন ভয়াবহ বিপর্যয় হলো তা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, প্রায় আড়াই বিলিয়ন লিবিয়ান দিনার (৫১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ডেরনা এবং পূর্বাঞ্চলীয় শহর বেনগাজীতে বাঁধ পুনর্নির্মাণের জন্য দেওয়া হবে।
সৌশা, আল মারজ এবং মিসরাতা শহরও রোববারের ঝড়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পানি প্রকৌশল বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শহরের ১২ কিলোমিটার দুরে আপার ড্যামই হয়তো প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরে দ্বিতীয় বাঁধ আর পানির তোড় সামলাতে পারেনি, যা ডেরনা শহর সংলগ্ন এলাকা।
“প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম যে এটা ভারী বৃষ্টিপাত। কিন্তু পরে মধ্যরাতের দিকে বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই এবং এই বিস্ফোরণ ছিলো বাঁধ এলাকায়,” রাজা সাশি নামে একজন বলছিলেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে। তিনি তার স্ত্রী এবং শিশু কন্যাসহ প্রাণে বেঁচেছেন।
তিউনিসিয়া ভিত্তিক লিবিয়ার সাংবাদিক নৌরা এলজেরবি বলেছেন, দেরনায় তার ৩৫ জন স্বজনের সবাই বেঁচে আছেন।
“ঘর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু আমার পরিবারের সবাই পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাবার আগেই বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। তারা এখন নিরাপদ।” বলছিলেন তিনি।
উদ্ধারকর্মী কাসিম আল কাতানি বলছিলেন, দেরনা শহরে এখন বিশুদ্ধ পানি নেই এবং ঔষধ সরবরাহেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
তিনি জানান যে দেরনার একমাত্র হাসপাতালটি এখন আর রোগী নিতে পারছে না। “সাত শ’রও বেশি মৃতদেহ পড়ে আছে হাসপাতালটিতে”।
তেল সমৃদ্ধ দেশ লিবিয়া ২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুর পর থেকেই রাজনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
এর একটি সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃত, যা রাজধানী ত্রিপোলিভিত্তিক। আরেকটি সরকার পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে।
লিবিয়ার সাংবাদিক আব্দুলকাদের আসাদ বলেছেন যে এ বিভ্রান্তির কারণেও উদ্ধার তৎপরতায় সমস্যা হচ্ছে। অনেকেই সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, কিন্তু সাহায্য আসছে না। কোনো উদ্ধারকারী দল নেই। লিবিয়াতে এখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্ধার কর্মীও নেই। সবকিছুই বার বছরের যুদ্ধে শেষ হয়ে গেছে।
তবে এই বিভাজন সত্ত্বেও ত্রিপোলিভিত্তিক সরকার একটি বিমানে ১৪ টন ঔষধ, মৃতদেহ বহনের জন্য ব্যাগ ও ৮০ জনেরও বেশি চিকিৎসক ও প্যারামেডিক পাঠিয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, তারা পাঁচ হাজার পরিবারের জন্য খাবার পাঠিয়েছে। দেরনা শহরটি বেনগাজীর আড়াই শ’ কিলোমিটার পূর্বদিকে। গাদ্দাফির পতনের পর এই শহরটি ছিল ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের একটি ঘাঁটি।
পরে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা এলএনএ তাদের বিতাড়ণ করে। এই এলএনএ পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ জেনারেল খালিফা হাফতারের প্রতি অনুগত।
প্রভাবশালী এই জেনারেল বলেছেন, বন্যার কারণে হওয়া ক্ষয়-ক্ষতি তারা নিরূপণ করছেন।
লিবিয়ার আল ওয়াসাত নিউজ ওয়েবসাইট বলছে, বহু বছর ধরে দেরনা শহরের রাস্তাঘাটর পুনর্নির্মাণ বা সংস্কার না হওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা এতো বেশি হয়েছে।
জেএন/এমআর