চট্টগ্রামের জেলা ও নগরীর অলিগলিতে যত্রতত্র সহজেই মিলছে ভেজাল ভোজ্য তেল। এর ফলে একদিকে যেমন সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমান রাজস্ব। ঠকছে ক্রেতা সাধারণ। অন্যদিকে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে সর্বসান্ত হচ্ছে ভোক্তা, এমনকি অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অনেকে।
এসব তেলের মধ্যে রয়েছে, সয়াবিন, পাম অয়েল, সুপার পাম ও সরিষার তেল। ভোজ্য তেল নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের তালিকার প্রথম দিকে থাকলেও একশ্রেণির অতিলোভী ব্যবসায়ীরা নিজেদের খেয়াল খুশি মতো এসব পণ্যে ভেজাল করে যাচ্ছে।
জানা যায়, মানুষের জীবিকা নির্বাহে ভোজ্য তেলের চাহিদার কথা বিবেচনা করে, চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে শহর এবং জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে খোলা তেলের প্যকেজিং কারখানা।
ভুঁইফোড় এসব তেলের কারখানাগুলো নামিদামি ব্র্যান্ডের মোড়কে চোখ ধাঁধানো বাহারি রংয়ের লেবেল লাগিয়ে খোলা তেল বেপরোয়া ভাবে বোতলজাত করে বাজারে বিক্রি করছে।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজার থেকে ড্রামে ড্রামে খোলা সয়বিন সংগ্রহ করে নির্ভয়ে বোতলজাত করে আসছে এক শ্রেণির অসাধু মুনাফা লোভী প্রতারক চক্র। বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়াই তাদের মনোগ্রাম শিলমোহর বোতলের লেবেলেও লাগিয়ে দিচ্ছে এই চক্রটি।
নিবন্ধনকৃত তেল প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো, বিশুদ্ধ তেলের প্যাকেট এবং তা বাজারজাত করতে সরকারের সকল প্রকার নিয়মকানুন অনুসরণ করার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কোন ছাড়পত্র ছাড়াই অবৈধভাবে খোলা তেলে বোতলজাত করে আসছে এই অসাধু চক্রটি। এতে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
জানা গেছে, সয়াবিন তেল প্যাকেজিং করতে বেশকিছু সরকারি সনদের প্রয়োজন হয়। যার মাধ্যমে সরকার ভ্যাট ট্যাক্স সংগ্রহ করে থাকেন। বিশেষ করে ট্রেড লাইসেন্স, ইন্ডাস্ট্রি এলাকার লোকেশনপত্র, তেল পরিশোধনের অটো মেশিন, তেলের মান নিয়ন্ত্রণকারী ল্যাব্রটারি, ভিটামিন এ মিক্সচারের জন্য ডোজিং মেশিন থাকা আবশ্যক।
এছাড়া অগ্নি নির্বাপক লাইসেন্স ও ব্যবস্থাপনা সামগ্রী, পরিবেশের সনদ, প্রিমিসেস সার্টিফিকেট (চসিক) স্থানীয় কাউন্সিলর/চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রত্যয়ন পত্র, নবায়নযোগ্য আয়কর সার্টিফিকেট, কৃষি সনদ, শ্রম অধিদপ্তর থেকে কলকারখানার সনদ, বাংলাদেশ সাইন্স ল্যাব কর্তৃক ক্যলিব্রিশন সনদ (ওজন মাপা), ফুড গ্রেট সনদ, বিএসটিআই কর্তৃক থার্মোমিটার ই,আর,সি এবং আই,আর,সি সনদ, এনবিআর’র আপডেট কাগজপত্রের অবশ্যই প্রয়োজন হয়।
সরকারি অনুমোদিত সকল প্রকার বৈধ কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হলে ভ্যাট ট্যাক্স ফি বাবদ কিছু টাকা পয়সা সরকারের সংশ্লিষ্ট রাজস্ব খাতে জমা দিয়ে বৈধ কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হয়।
সূত্র জানায়, লক্ষ লক্ষ টাকা আয়কর ফাঁকি দিয়ে সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে খোলা তেল প্যকেজিং এর মাধ্যমে রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালী চক্র। এতে বছরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
এছাড়া তেলের বাজারে অস্থিরতা মূল্য বৃদ্ধি,ওঠা নামার নেপথ্যে কলকাঠিও নাড়াচ্ছ এই চক্রটি। একসাথে ক’য়েক হাজার টন তেলের ডিউ কিনে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করে লিটার প্রতি ১০/২০ টাকা বাড়িয়ে দৈনিক লক্ষ লক্ষ লিটারে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে সূত্র জানায়।
চট্টগ্রামে অবৈধ তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ চক্রের অন্যতম সদস্য বায়েজিদ থানাধীন নয়াহাটের জসিম স্টোরের পাশে একটি ঘরে মো. আ. হালিম।
তিনি এস,এস কর্পোরেশনের ব্যনারে ক্লাসিক ব্রান্ডের মোড়কে খোলা তেল বোতলজাত করছে। “নূর” সয়াবিন ব্রান্ডের মালিক মো. আরজু মিয়া। তারও বোতলজাতকৃত খোলা তেল বাজারে চলমান রয়েছে।
বায়েজিদ থানাধীন টেনারি বটতল এলাকায় তার কারখানা। “রেসিপী” ব্র্যান্ডের মালিক মো. মিজান খোলাতেল বােতলজাত করছেন অক্সিজেন এলাকার ওয়াবদার গেইট তার কারখানা থেকে।বায়েজিদ থানাধীন অক্সিজেন, ওয়াবদা গেইট সংলগ্ন রয়েছে তার কারখানা।
আজমীর/কাশ্মীর মোড়কে তেল বাজারে দেখা যায়, তবে এর মালিক আবুল বশরের স্ত্রী রোজিনা বেগমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, চার মাস আগে তার স্বামী আবুল বশর মারা গেছেন। এখন তাদের ব্যবসা বন্ধ। এর আগে যেসব মাল বাজারে ছাড়া হয়েছে, সেগুলো হয়তো কোন কোন দোকানে থাকতে পারে।
“এস,আমানত” ব্রান্ডের মালিক মো. হোসাইন, বর্তমানে তার আপন ভাই মো. আলমগীর তার ব্যবসা পরিচালনা করছে। শাহ্ আমানত সেতুর দক্ষিণ পাড় মইজ্জারটেক এস আলম অয়েল মিল সংলগ্ন তার কারখানা। “ফ্রেশলী” নামের আরেকটি ব্র্যান্ড যার মালিক মো. শফি, মইজ্জার টেক, কর্ণফুলী থানা এলাকায় তার কারখানা রয়েছে।
নূর-ত্রিবিনীঃ এস,এস, অয়েল ট্রেডিং এর মোড়কে খোলা তেল বোতলজাত করছেন মো. সেলিম হাওলাদার। অক্সিজেন এলাকার নয়া হাটের উত্তরে একটু ভিতরে তার কাখানা। “রাইসা” ব্র্যান্ডের মালিক মো. জাহাঙ্গীর, বিবির হাট, ফটিকছড়ি চট্টগ্রাম। “আল নূর” ব্রান্ডের মালিক মো. রাশেদ, শান্তির হাট রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
বোয়ালখালী উপজেলার, ফুলতলা এলাকায় খোলা তেল আর খোলা ঘি একসাথেই প্যাকেজিং করছেন মো. এমদাদ নামের এক ব্যবসায়ী।
জানা গেছে, বিএসটিআই এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একাধিকবার শাস্তি প্রদান করেও এদেরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। দন্ডপ্রাপ্ত অসাধু ব্যবসায়ীরা স্থান পরিবর্তন করে ভিন্ন স্থানে গিয়ে পুনরায় একই অপকর্মে লিপ্ত হয়।
সুত্র জানায়, চাক্তাই খাতুনগঞ্জ এলাকা থেকে এস,আলম, সিটি গ্রুপ, টিকে, কর্ণফুলী গ্রুপ হতে খোলা তেল পাইকারি হিসাবে ক্রয় করে, ১৮৬ কেজি ওজনের প্লাস্টিক ড্রামে ভর্তি করে নগর ও জেলার বিভিন্ন নির্জন নিরাপদ স্থানে নিয়ে প্লাস্টিক বোতলজাতের মাধ্যমে রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে চক্রের সদস্যরা।
জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষার্থে খোলা তেল বাজারজাত করতে সরকারি যেসকল নিয়ম কানুনের দরকার হয়, তার একটিও মানছেনা তারা।
জেএন/এফও/পিআর