এবারের বিশ্বকাপে এই প্রথম বড় কোনো অঘটনের জন্ম দিলো আফগানিস্তান। আগের দুই ম্যাচে গো-হারা আফগানিস্তান আজ দিল্লির অরুন জেটলি স্টেডিয়ামে হারিয়ে দিয়েছে গত বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে।
টস জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত যে ইংলিশ অধিনায়ক জস বাটলারের জন্য কতবড় ভুল ছিল, তা ম্যাচ শেষে এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। টস হেরে ব্যাট করতে নেমে রহমানুল্লাহ গুরবাজের ব্যাটিং তাণ্ডবে ২৮৪ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর সংগ্রহ করে আফগানিস্তান।
জবাব দিতে নেমে আফগান স্পিনের সামনে খেই হারিয়ে ফেলে ইংলিশরা। মুজিব-উর রহমান, রশিদ খান এবং মোহাম্মদ নবির মায়াবি ঘূর্ণিতে দিশেহারা হয়ে ৪০.৩ ওভারে ২১৫ রানেই অলআউট হয়ে যায় বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। যার ফলে আফগানিস্তানের জয় এলো ৬৯ রানে।
এ নিয়ে তৃতীয় ম্যাচ খেললো আফগানিস্তান এবং ইংল্যান্ড। দুই দলই দুটি করে ম্যাচ হেরেছে এবং জিতেছে একটি করে ম্যাচ। ইংল্যান্ড হেরেছে নিউজিল্যান্ড এবং আফগানিস্তানের কাছে। আর আফগানিস্তান হারলো বাংলাদেশ ও ভারতের কাছে।
২৮৫ রানের পুঁজি নিয়েই লড়াই করতে নামে আফগান বোলাররা। দ্বিতীয় ওভারেই আফগানিস্তানকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেন বা হাতি পেস বোলার ফজল হক ফারুকি। আগের ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে দুর্দান্ত খেলা জনি বেয়ারস্টোকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেন এই পেসার।
বেয়ারস্টো সঙ্গে সঙ্গে রিভিউ নিলেও বাংলাদেশ আম্পায়ার সৈকতের বিচক্ষণ সঠিক সিদ্ধান্তকেই বহাল রাখেন টিভি আম্পায়ার। শুরুতেই উইকেট হারিয়ে যেন বিপদেই পড়ে ইংলিশরা।
দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ডেভিড মালান ও জো রুট কিছুটা বিপর্যয় সামাল দেন ৩০ রানের জুটি গড়ে। কিন্তু ৭ম ওভারেই সেই জুটি ভাঙেন স্পিনার মুজিব। তার অসাধারণ এক ডেলিভারিতে বোল্ড হন আগের দুই ম্যাচে অর্ধশতক করা জো রুট।
প্রথম পাওয়ারপ্লেতে ৫২ রানে দুই উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে ইংল্যান্ডরা। আফগান স্পিনে দিশেহারা হয়ে পড়ে তারা। ১৩তম ওভারে আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ারন ডেভিড মালানকে আউট করে আবারো ইংল্যান্ডকে ব্যাকফুটে ফেলেন অফ স্পিনার মোহাম্মদ নবী। ১৫০তম ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে নামা এই বোলার বলে মালান শর্ট এক্সট্রা কাভারে ইব্রাহিম জারদানের হাতে ধরা পড়েন।
৯০ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর অধিনায়ক জস বাটলারকেও হারায় তারা। নাভিন উল হকের অসাধারণ এক ইন সুইং ডেলিভারিতে বোল্ড আউট হন জস বাটলার। মাত্র ১৮ বলে ৯ রান করেন এই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান। বাটলারের আউটের দুই ওভার পরেই রশিদ খানের বলে এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়েন লিভিংস্টোন।
১১৭ রানে ৫ উইকেট হারানো ইংল্যান্ডের এক পাশে যখন ব্যাটসম্যানদের আসা যাওয়ার মিছিল চলছিল ঠিক অন্যপাশে আফগান বোলারদের উপর চড়াও হচ্ছিলেন হ্যারি ব্রুক। তুলে নিনে অর্ধশতকও।
২৮তম ওভারে আবারো ব্রেক থ্রু এনে দেন স্পিনার নবী। এবার তার বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন স্যাম কারান। ক্রিস ওকসও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। ৩৩তম ওভারে তাকেও প্যাভিলিয়নে ফেরান মুজিব।
মুজিবের বোলিংয়ের কারিশমা তখনও শেষ হয়নি। এরপরের ওভার করতে এসেই ইংলিশদের এই ম্যাচের সেরা ব্যাটসম্যান ৬১ বলে ৬৬ রান ব্রুককে আউট করলে কার্যত ইংলিশদের জয়ের আশা সেখানেই শেষ হয়ে যায়। এরপর শেষের দিকে আদিল রশিদ ২০, ক্রিস উড ১৮ ও রিস টপলি ১৫ রান করলেও তা ম্যাচ জয়ের মত যথেষ্ট ছিল না। শেষ পর্যন্ত ৪০.৩ ওভারে সবকটি উইকেট হারিয়ে ইংলিশরা ২১৫ রানেই থামে।
আফগানিস্তানের হয়ে মুজিব ৩টি, নবী ও রশিদ খান ২টি, ফজলহক ফারুকী ও নাভিন উল হক ১টি করে উইকেট পান।
এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নামতে হয় আফগানিস্তানকে। রহমানুল্লাহ গুরবাজের টর্নেডো ব্যাটিংয়ের ওপর ভর করে অসাধারণ সূচনা করেছিলো আফগানরা। তবে ১১৪ থেকে ১২২ রানের মধ্যে ৩ উইকেটের পতনে থমকে যায় তাদের ইনিংস। ইকরাম আলিখিল ৫৮ রান করার ফলে শেষ পর্যন্ত ৪৯.৫ ওভারে ২৮৪ রানে অলআউট হয় আফগানিস্তান।
প্রথম ১৫টি ওভার যেন স্বপ্নের মত কেটেছিলো আফগানিস্তানের। কোনো উইকেট হারাতে হয়নি। রান তুলে ফেলেছে ১১০-এর বেশি। ইংল্যান্ডের মত দলের বিপক্ষে এমন স্বপ্নের শুরু কবে করতে পেরেছিলো আফগানরা!
কিন্তু এই সুখস্মৃতি খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। একে একে তিনটি উইকেট হারিয়ে ব্যাটিং বিপর্যয়েই পড়ে যায় আফগানরা। তিন নম্বর ব্যাটার হিসেবে রানআউট হন দুর্দান্ত ব্যাটিং করতে থাকা রহমানুল্লাহ গুরবাজ।
১৯তম ওভারের পঞ্চম বলে হাশমতউল্লাহ শহিদি ব্যাট করছিলেন। আদিল রশিদকে ঠেলে দিয়েই দ্রুত একটি রান তুলতে যান তিনি। মিড উইকেটে ফিল্ডার ছিলেন ডেভিড উইলি। তিনি বল থ্রো করেন ব্যাটিংপ্রান্তে। বল ধরেই উইকেট ভেঙ্গে দেন জস বাটলার। সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় ৫৭ বলে ৮০ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস।
পরপর দুই বলে দুটি উইকেট হারিয়েই ব্যাকফুটে চলে যায় আফগানিস্তান। লড়াইয়ে নিজেদেরকে চালকের আসনে নিয়ে আসে ইংল্যান্ড।
আগে টস হেরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাট করতে নামার পর আফগানদের ঠিক ‘আফগানিস্তানে’র মতো মনে হচ্ছিল না। এই মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা যেভাবে বোলারদের পিটিয়েছিলো, ঠিক তেমনটাই মনে হচ্ছিলো রহমানুল্লাহ গুরবাজ এবং ইবরাহিম জাদরানের ব্যাটিংয়ে।
শেষ পর্যন্ত এই দু’জনের উদ্বোধনী জুটি ভাঙতে সক্ষম হন ইংলিশ লেগ স্পিনার আদিল রশিদ। ১১৪ রানের বিশাল জুটি গড়ার পর বিচ্ছিন্ন হলেন গুরবাজ এবং ইবরাহিম। আদিল রশিদকে মিডউইকেটের ওপর দিয়ে মেরে বাউন্ডারি আদায় করতে চেয়েছিলেন ইবরাহিম। কিন্তু শর্ট মিডউইকেটে সরাসরি জো রুটের হাতে ধরা পড়েন তিনি। ৪৮ বলে ২৮ রান করে আউট হলেন ইবরাহিম।
এরপর রহমত শাহ মাঠে নেমে খুব বেশিদূর যেতে পারেননি। মাত্র ৩ রান করে ফিরে যান সাজঘরে। হাশমতউল্লাহ শহিদির ভুলে তো রান আউট হলেন রহমানুল্লাহ গুরবাজ। ৫৭ বলে ৮০ রানের ইনিংসে গুরবাজ ৮টি বাউন্ডারির সঙ্গে ছক্কা মারেন ৪টি।
হাশমতউল্লাহও বেশিক্ষণ খেলতে পারেননি। ৩৬ বল খেলে মাত্র ১৪ রানে আউট হন তিনি। ২৪ বলে ১৯ রান করেন আজমতউল্লাহ ওমরজাই। ৬৬ বলে ৫৮ রান করেন ইকরাম আলিখিল। মোহাম্মদ নবি আউট হন ৯ রান করে। ২২ বলে ২৩ রান করেন রশিদ খান। তবে শেষ মুহূর্তে ঝড় তুলেছিলেন মুজিব-উর রহমান। ১৬ বলে ২৮ রান করেন তিনি। নাভিন-উল হক রানআউট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয় আফগানদের ইনিংস। তখনও একটি বল বাকি ছিল তাদের।
ইংল্যান্ডের হয়ে ৩ উইকেট নেন আদিল রশিদ। ২ উইকেট নেন মার্ক উড। ১টি করে উইকেট নেন রিসি টপলি, লিয়াম লিভিংস্টোন এবং জো রুট।
জেএন/এমআর