গ্যাস ও বিদ্যুৎ নিয়ে উভয় সংকটে চট্টগ্রামের বাসিন্দারা। সময়ে সময়ে চুলায় থাকছে না গ্যাস। এতে বাসাবাড়িতে রান্নায় পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ। পাশাপাশি বিদ্যুতের লোডশেডিংয়েও নাকাল নাগরিকরা। ২৪ ঘণ্টাই ঘন ঘন যাওয়া-আসা করছে বিদ্যুৎ।
যোগাযোগ করলে গ্যাস সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কথা বলছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। আবার ফার্নেস অয়েলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতেও কমে গেছে উৎপাদন। তবে চাহিদা দিয়েও ফার্নেস অয়েল নিচ্ছে না পিডিবি- এমন অভিযোগ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি)।
লোডশেডিংয়ের মতো বিদ্যুতের উৎপাদন সরবরাহের তথ্য নিয়েও ইঁদুর-বিড়াল খেলছেন পিডিবির কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামে এ বিষয়ে কথা হলে পিডিবি দক্ষিণাঞ্চল বিতরণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল সোমবার (২৩ অক্টোবর) বলেন, ‘সারাদেশে কেন্দ্রীয়ভাবে বিদ্যুতের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে নির্ধারণ করা লোড অনুযায়ী দেশের প্রত্যেকটি এরিয়া বিদ্যুৎ পায়। শুধু ন্যাশনাল গ্রিড থেকে কম পাওয়ার কারণে বাধ্য হয়েই চট্টগ্রামে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
সোমবার দুপুরে ৭০-৮০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, গ্যাসের সংকট রয়েছে। এ কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন কিছুটা কম। গত দু-তিন দিন ধরে লোডশেডিং হচ্ছে।
তবে লোডশেডিংয়ের বিষয়টি মানতে নারাজ পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার। তিনি বলেন, ‘দেশের কোথাও লোডশেডিং হচ্ছে না।’
তবে চট্টগ্রামের কর্মকর্তাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বড় এলাকা। এখানে বিদ্যুতের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। তবে আমাদের নোটিশে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা চট্টগ্রামে লোড বাড়িয়ে দিচ্ছি।’
বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গ্যাসের কিছুটা সংকট রয়েছে। যে কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব পড়ছে। তারপরেও অন্য বিকল্প জ্বালানির সোর্স থেকে নিয়ে আমরা সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রেখেছি।’
আগ্রাবাদের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম টিটু বলেন, সোমবার সকাল ৯টা থেকে আমাদের বাসায় গ্যাস ছিল না। দুপুরের পরেও ছিল না। বিকেলে এসেছে। রাইস কুকারে রান্না করে খেতে হয়েছে।
বাকলিয়া এলাকার বাসিন্দা আনোয়ারা শিরীন বলেন, দিনে কয়েকবার করে বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করে। মাসের পর মাস এমন হচ্ছে। রোববার সন্ধ্যায় এক ঘণ্টার বেশি সময় বিদ্যুৎ ছিল না। কাউকে অভিযোগ করেও কাজ হয় না।
পিডিবির তথ্যমতে, আমদানি করা ভারতীয় তিনটিসহ দেশীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বর্তমানে ২৪ হাজার ৫৯৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় তিন বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির কথা রয়েছে। সবশেষ গত ২২ অক্টোবর সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি ১৫৯ বিদ্যুৎকেন্দ্রে পিক আওয়ারে ১১ হাজার ২৩৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।
এর বাইরে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে ভারতের তিন বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানি করা ১৬৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ত্রিপুরা থেকে ১১৬ মেগাওয়াট, ভেড়ামারা এইচভিডিসি (হাই ভোল্টেজ ডাইরেক্ট কারেন্ট) দিয়ে ৮৫১ মেগাওয়াট এবং ঝাড়কান্দ আদানি পাওয়ার থেকে ৭১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে দেশের জাতীয় গ্রিডে।
গত ২১ অক্টোবর সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি ১৫৯ বিদ্যুৎকেন্দ্রে পিক আওয়ারে ১১ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এর বাইরে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয় ভারত থেকে আমদানি করা ১৩৭৮ মেগাওয়াট।
তথ্য অনুযায়ী, ২২ অক্টোবর চট্টগ্রামের ৩ হাজার ১৫৭ মেগাওয়াট সক্ষমতার ২২টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে পিক আওয়ারে ১৫শ ৩৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়েছে। ওইদিন এস আলম গ্রুপের এস এস পাওয়ার থেকে যুক্ত হয়েছে ৪শ মেগাওয়াট। ২১ অক্টোবর চট্টগ্রামের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদিত হয় ১৬শ ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর মধ্যে এস এস পাওয়ার থেকে যুক্ত হয় ৬২০ মেগাওয়াট।
চট্টগ্রামের ২২টি প্ল্যান্টের মধ্যে এই দুদিন ফার্নেস অয়েল সংকটের কারণে ১৩টিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হয়েছে। এর মধ্যে ২২ অক্টোবর ফার্নেস অয়েল সংকটে শিকলবাহা ১০৫ মেগাওয়াট বারাকা পাওয়ার প্ল্যান্টে ১৭ মেগাওয়াট, হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে ৫৮ মেগাওয়াট, দোহাজারী কালিয়াইশ ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে ২৯ মেগাওয়াট, জুলধা একর্ন পাওয়ারের ১০০ মেগাওয়াটের তিনটি প্ল্যান্টে ১২ মেগাওয়াট করে, ১১০ মেগাওয়াট কর্ণফুলী পাওয়ার প্ল্যান্টে ১৬ মেগাওয়াট, ১১৬ মেগাওয়াটের আনলিমা এনার্জিতে ৪৭ মেগাওয়াট এবং মীরসরাই ১৬৩ মেগাওয়াটের প্ল্যান্টে উৎপাদিত হয়েছে মাত্র ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
তাছাড়া গ্যাস সংকটে বন্ধ রয়েছে ৪২০ মেগাওয়াট রাউজান বিদ্যুৎকেন্দ্র। বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণ জটিলতায় চট্টগ্রামের শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল পাওয়ার প্ল্যান্টও বন্ধ। তবে চালু রয়েছে গ্যাসনির্ভর ২২৫ মেগাওয়াট শিকলবাহা রিসাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট।
এদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, চাহিদা দিয়েও ফার্নেস অয়েল নিচ্ছে না পিডিবি। বিপিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘অক্টোবর মাসের জন্য পিডিবির পক্ষ থেকে এক লাখ ৩৯ হাজার ৪৫০ টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা দেওয়া হয়। পিডিবির চাহিদা পূরণের জন্য ডলার সংকটের মধ্যেও ফার্নেস অয়েল সংগ্রহে রেখেছে বিপিসি। কিন্তু ২২ অক্টোবর পর্যন্ত চাহিদা থেকে মাত্র ৬২ হাজার ৫শ টন ফার্নেস অয়েল নিয়েছে পিডিবি।
ফার্নেস অয়েল সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হলেও বিষয়টি মানতে চাননি পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার। তিনি বলেন, ‘আমরা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ করছি। এক সোর্সে উৎপাদন কম হলে অন্য সোর্স থেকে নিয়ে উৎপাদন স্বাভাবিক রেখেছি।’
তবে চাহিদা দিয়েও বিপিসি থেকে ফার্নেস অয়েল সরবরাহ না নেওয়ার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
অন্যদিকে গ্যাসের অভাবেও নাকাল হতে হচ্ছে চট্টগ্রামের লোকজনদের। লাইনের গ্যাস না থাকলেও সিলিন্ডারের এলপি গ্যাস দিয়ে অনেক মানুষ রান্নাবান্নার কাজ সারছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন কমে গেছে। বছরের ব্যবধানে প্রায় দুই থেকে তিনশ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন কমে যাওয়ার তথ্য দিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা পেট্রোবাংলা।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, গত ২২ অক্টোবর ২ হাজার ৬৯২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করেছে পেট্রোবাংলা। এরমধ্যে দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২ হাজার ৯১ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আমদানি করা এলএনজি থেকে ৬০১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পায় পেট্রোবাংলা। চট্টগ্রামের জন্য কর্ণফুলী গ্যাসকে দেওয়া হয় ২৭৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বর্তমানে দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২ হাজার ৭৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) বলছে, বর্তমানে সারাদেশে গ্যাসের চাহিদা৪ হাজার ২শ মিলিয়ন ঘনফুট।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, কেজিডিসিএলে ৬ লাখ ২ হাজার ৩৮৫ গ্রাহক রয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, চারটি সার কারখানা, ১ হাজার ১৮৭টি শিল্প সংযোগ, ২০৫টি ক্যাপটিভ পাওয়ার, ২ হাজার ৯১১টি বাণিজ্যিক সংযোগ, দুটি চা-বাগান, ৭০টি সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন এবং গৃহস্থালি সংযোগ রয়েছে ৫ লাখ ৯৮ হাজার একটি। বর্তমানে ৬০ হাজার গ্রাহক প্রিপেইড সুবিধার আওতায় রয়েছেন। বর্তমানে আরও এক লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপনের প্রকল্প চলমান। এরপর আরও চার লাখ ৩৮ হাজার একজন আবাসিক গ্রাহক প্রিপেইড মিটারের বাইরে রয়েছে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস) প্রকৌশলী মো. শফিউল আজম খান বলেন, ‘এখন গ্যাসের সংকট রয়েছে। আমাদের ৩৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হলে সবগুলো সমন্বয় করে চালিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু এখন চাহিদা মোতাবেক গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন ৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস কম পাওয়া যাচ্ছে। এখন সার কারখানা দুটিতে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ সরবরাহ কিছুটা কমানো হয়েছে।
গৃহস্থালি গ্রাহকদের গ্যাস সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গ্যাসের চাপ কমে গেলে এমনিতেই আবাসিক গ্রাহকরা গ্যাস কম পান। চাপ বাড়লে স্বাভাবিক হয়ে যায়।’