শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চোরাচালান করে আনা চারটি সোনার বারসহ আটক হওয়া সেখানে কর্তব্যরত স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এম জেড এ শরীফকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় কোনো মামলাও দায়ের করেনি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে অভিযুক্ত চিকিৎসক যে ব্যক্তির সোনা পরিবহন করেছিলেন তাকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এটি সম্পূর্ণরূপে বেআইনি হয়েছে বলে মনে করছেন ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞরা।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসে অভিযুক্ত চিকিৎসককে তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে আইনজীবীরা বলছেন, সোনার বারগুলোর মালিক একজন সাধারণ যাত্রী। এখানে একজন চিকিৎসক সেগুলো পরিবহন করেছেন। বিষয়টি তিনি নিজে স্বীকারও করেছেন। এর মানে তিনি সরাসরি চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা দায়েরই একমাত্র ব্যবস্থা।
জানা গেছে, সোমবার (২৯ জানুয়ারি) সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ডা. এম জেড এ শরীফকে চারটি সোনার বারসহ আটক করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
অভিযুক্ত শরীফ ২৭তম বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা। তিনি ২০১২ সাল থেকে বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। তার স্ত্রীও একজন ডাক্তার। পতেঙ্গা থানার বন্দরটিলা এলাকার বাসিন্দা শরীফ প্রায় একযুগ ধরে বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জড়িয়েছেন স্বর্ণ চোরাচালান চক্রে।
ওই সময় অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সেখানে অভিযানে থাকা কর্মকর্তারা এম জেড এ শরীফকে কোন পদে আছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি নিজেকে হেলথ অফিসার হিসেবে পরিচয় দেন।
কাস্টমস সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে ডা. শরীফ স্বীকার করেন, সকালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে চট্টগ্রামে পৌঁছান। ওই ফ্লাইটে দেশে ফেরেন চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ হালিশহর নাবিক কলোনির বাসিন্দা মো. আলাউদ্দিন। তিনি ৪৬৪ গ্রাম ওজনের চারটি স্বর্ণের বার আনেন।
বিমানবন্দরে পৌঁছে অভিযুক্ত আলাউদ্দিন ডা. শরীফের কাছে সোনার বারগুলো হস্তান্তর করেন। শরীরে লুকিয়ে অভিযুক্ত চিকিৎসক সোনার বারগুলো বিমানবন্দর পার করে দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে তার শরীর তল্লাশি করে কাস্টমস কর্মকর্তারা সোনার বারগুলো জব্দ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সোনা চোরাচালানের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্যে মো. আলাউদ্দিনকে আটক করা হয়। যদিও কোনো মামলা না করে দুজনকেই ছেড়ে দেওয়া হয়।
মামলা না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমি বিষয়টি টিভিতে দেখেছি। এখন পর্যন্ত আমার কাছে কেউ আসেনি, মামলাও হয়নি।
অ্যাডভোকেট আবদুর রশীদ বলেন, এখানে একজন ব্যক্তির সোনা একজন চিকিৎসক পরিবহন করেছেন। ওই চিকিৎসকের কাছ থেকে সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। তার মানে তিনি চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করতে হবে। একই সঙ্গে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। মামলা না নিয়ে ছেড়ে দেওয়ায় আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিমানবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মহিউদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, অভিযুক্ত চিকিৎসককে স্বাস্থ্য বিভাগের তিনজন কর্মকর্তার জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন- স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. সুমন বড়ুয়া, ডা. ইফতেখার উদ্দিন ও বন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. জাবেদ। আর জব্দকৃত সোনার বারগুলো রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত দেখানো হয়েছে। জিম্মায় নেওয়ার সময় অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
একটা ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হয়েছে? জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার বলেন, ‘সবকিছু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হয়েছে।’
এদিকে ঘটনার পরপর বিমানবন্দর থেকে ডা. শরীফকে প্রত্যাহার করেছে চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগ। ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে দুই সদস্যের কমিটি। কমিটির সদস্যরা হলেন- চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সুমন বড়ুয়া ও ডেপুটি সিভিল সার্জন ওয়াজেদ চৌধুরী অভি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক ডা. ইফতেখার আহমদ জানান, ২০১২ সাল থেকে শরীফ শাহ আমানতে কর্মরত। এ ঘটনায় তাকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার ও ২ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি নেওয়া হবে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের রাজস্ব কর্মকর্তা আল আমীন বলেন, বিমানবন্দরে দায়িত্বরত অনেকেই স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার খবর ছিল আমাদের কাছে। ভিআইপি গেইটে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি সন্দেহভাজনদের বিশেষ নজর রাখা হয়। এরই অংশ হিসেবে ডা. শরীফকে আটক করা হয়েছে।
এদিকে চিকিৎসক আটকের ঘটনায় শাহ আমানত বিমানবন্দরে কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। নিজ শাখার বাইরে না যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিমানবন্দর পরিচালক। প্রত্যেক শাখা প্রধানরা বিষয়টি কঠোরভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। আত্মীয়-স্বজনকে কোনো ধরনের প্রটোকল না দেওয়া এবং কাস্টমস হলে প্রবেশ না করতে বলা হয়েছে।
এসএ