ইসরায়েল-হামাসের চলমান যুদ্ধের মধ্যেই বাংলাদেশের একটি পাঠ্যপুস্তকে ফিলিস্তিনের নাম না দিয়ে ইসরায়েলকে কীভাবে যুক্ত করা হল, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল সমালোচনা চলছে। স্কুলপাঠ্য বইয়ে এ ধরনের ভুল নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদেরও।
এই পাঠ্যপুস্তক সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা দুইজন ব্যক্তিই এই ভুলের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, এই ভুল সংশোধনের পাশাপাশি নতুন করে ‘ফিলিস্তিন পরিচিতি’ অধ্যায়ও যুক্ত করার সুপারিশও করবেন তারা।
সম্পাদনা পরিষদের সদস্য আবুল মোমেন বলেন, “ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটি কীভাবে বঞ্চিত হয়েছে এটা ক্লিয়ার করে দেয়ার চেষ্টা থাকবে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কাছে।”
এত পর্যবেক্ষণের পরও পাঠ্যপুস্তকে কেন এমন ভুল হল তা নিয়ে এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাদের রিপোর্টে লেখকদের গাফিলতির প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “কমিটির রিপোর্টে ভুল প্রমাণিত হলে আমরা ওই পাতাগুলোকে কারেকশন করে সমস্ত জায়গায় পাঠিয়ে দিবো। তখন শ্রেণি শিক্ষকরা ওটা প্রতিস্থাপন করে দিবেন।”
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এনসিটিবির চরম দায়িত্বহীনতার প্রমাণ এই ভুল। শুধু এবার নয়, বার বার এমন ভুলের প্রভাব পড়ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, “যে বই লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী পড়বে, সে বই সম্পাদনার ক্ষেত্রে যে সচেতনতা থাকা উচিত তা ছিল না। ভুল থাকার পরও বইগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া খুবই বিপদজনক। এটা একরকম দায়িত্বহীনতা”।
কী আছে নবম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে?
বিতর্কটা প্রথম শুরু হয় নবম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের দাখিল-নবম শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান বইয়ের একটি অধ্যায় নিয়ে। বইয়ের ১৪৯ পৃষ্ঠায় ‘মিলেমিশে নিরাপদে বসবাস’ অধ্যায়ের ‘নগর বসতি’ অংশে ‘জিওগ্রাফি অব টাউনস’ নামে একটি অংশকে তুলে ধরা হয়। যেখানে বলা হয়েছে, প্রাচীন নগরের উৎপত্তি কোনও না কোনও নদী উপত্যকায় হয়েছিল।
সেখানে আরও বলা হয়, “ইতিহাসবিদদের মতে নগরায়নের সর্বপ্রথম বিকাশ ঘটে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার জর্ডান নদী উপত্যকায় অবস্থিত জেরিকো নামক স্থানে।” এই পরিচ্ছেদ শেষে প্রাচীন জেরিকো নগরের অবস্থান নিয়ে একটি মানচিত্র দেওয়া হয়। ওই মানচিত্রে জুডিয়া ও সামারা নামে দুটি জায়গার পরিচিতিও দেওয়া হয়েছে।
বইয়ের এই জায়গাটি নিয়েই মূলত সমালোচনা তৈরি হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন স্ট্যাটাসে বলা হচ্ছে, জুডিয়া ও সামারা নামদুটি সাধারণত ইসরায়েল ব্যবহার করে থাকে। মুসলিম বিশ্বে এ দুটো এলাকা পশ্চিম তীর নামে পরিচিত।
ওই মানচিত্রে বর্তমান ফিলিস্তিনের অংশ যে গাজা ভূখণ্ড, সেটিকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘গাম্বিয়া’ নামে। ফেসবুক স্টাটাসে কেউ কেউ অভিযোগ করে বলছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে ইসরায়েলের নাম ব্যবহার করা হলেও সেখানে ফিলিস্তিনের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
তারা প্রশ্ন তুলছেন, বাংলাদেশ যেখানে এখনও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি, সেখানে পাঠ্যবইয়ে সেই নামটি কীভাবে যুক্ত করা হল?
আসল ভুলটা কোথায়?
এই সমালোচনা শুরুর পর পরই বিষয়টি নিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদ ইসলাম একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠান গণমাধ্যমে। যেখানে বলা হয়, “জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রণীত ২০২৪ সালের বইয়ের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও গভীর পর্যবেক্ষণে যে সকল বিষয় উঠে এসেছে তা আমরা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছি।”
এই বিজ্ঞপ্তি সমালোচনাকে ইতিবাচক ধরে ‘যৌক্তিকভাবে মূল্যায়ন করে’ সংশোধনী আনার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু কোন বইয়ের কোন ভুলের কারণে এই বিজ্ঞপ্তি, সেটি নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের যারা লেখক ছিলেন তারা যদি মনে করেন ভুল ছিল তাহলে এক ধরনের ব্যবস্থা হবে। আর লেখক যদি মনে করেন ভুল হয়নি, তাহলে আরেক ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
তিনি বলেন, সবাই বলবে এ ভুল ও ভুল, সব ভুল ভুল না। কমন চিন্তাধারায় ভুল পরিলক্ষিত হলে আমরা প্রয়োজনীয় সংশোধন দিয়ে দেবো।
বইয়ের সম্পাদকরা কী বলছেন?
এই বইটি সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক আবুল মোমেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলম। বইয়ের এই অংশে ভুলের বিষয়টি তারা দুজনই মানছেন।
কিন্তু কেন ও কীভাবে এই ভুল হল, তা নিয়ে দুই ধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে তাদের কাছ থেকে। অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলম বলেন, “এই বইয়ের ইতিহাস অংশ আমি দেখেছি ও লেখার সাথেও জড়িত ছিলাম। তবে সামাজিক বিজ্ঞান চ্যাপ্টারটা আমার দেখারও সুযোগ হয়নি।”
তিনি বলেন, ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে এই বইয়ে ভুল ম্যাপ ছাপা হয়েছে। আমার ধারণা কোনও কারণবশত ভুল ছাপা হয়েছে।
বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর ধরে পাঠ্য বইয়ের ভুল নিয়ে নানা সমালোচনা দেখা যাচ্ছে। এ কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যখনই কোনও পাঠ্য পুস্তক প্রকাশ করা হয়, তখন তা কয়েক ধাপে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
তিনি বলেন, “কমিটি দুইবার তিনবার এডিট করেছে। অনেকে রিভিউ করেছে ম্যাপগুলো বদলাতে হবে। বদলানোও হয়েছিল, শেষে কী করে এমন একটা ম্যাপ চলে আসলো, আমার মনে হয় ভুল প্রিন্টিংয়ের সময় হয়ে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, এখানে প্রাচীন নগরের কথা বলা হচ্ছে, অথচ নামগুলো সব আধুনিক দেশের। ম্যাপটাই তো ওইটার সাথে প্রাসঙ্গিক হচ্ছে না। নামগুলো তো আরো অনেক পরের কথা।
বইয়ের ইতিহাস অংশ, অর্থাৎ ম্যাপ ও যে অংশের ভুল নিয়ে এই সমালোচনা হচ্ছে সেটির দায়িত্বে ছিলেন সাংবাদিক আবুল মোমেন। তিনি বলেন, “আমি যখন একটা মানচিত্র করব, তখন সেটা অথেনটিক হতে হবে। অথেনটিক করতে গেলে ইসরায়েল রাষ্ট্রটা আছে। তাহলে ইসরাইল রাষ্ট্রের পরিচিতি আমি যদি না দেই তাহলে লোকে সেটা বুঝবে কী করে!”
তিনি বলেন, আসলে যে ম্যাপ এসেছিল আমাদের কাছে সেখানে কিন্তু গাজার জায়গায় গাজা-ই লেখা আছে। কিন্তু গাজা কিভাবে গাম্বিয়া হয়ে গেল এটি নিয়ে আমরাও বিস্মিত”।
তিনি আরও বলেন, “গাম্বিয়া তো আফ্রিকার একটা দেশ। আমার ধারণা ইংরেজি থেকে বাংলা করার সময় যারা ইলাস্ট্রেটর, তাদের কারণেই এটি হয়েছে। এটি অবশ্যই বড় একটি ভুল।”
ফিলিস্তিনের পরিচিতি যুক্ত করার সুপারিশ
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সপ্তম শ্রেণির বইয়ে ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বই ছিড়ে প্রতিবাদের ঘটনার পর নতুন করে পাঠ্য বইয়ের ভুলভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
ঠিক এর পরপরই আলোচনায় আসে নবম শ্রেণির বইয়ের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুটি। যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এক ধরনের সমর্থন ও আবেগ কাজ করে। সম্ভবত এই কারণেই বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার শুরুতেই বেশ তৎপরতা দেখা যাচ্ছে মন্ত্রণালয় ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের।
এনটিসিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। রিপোর্টের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় যে নির্দেশনা দেবে, সেই নিদের্শনা অনুযায়ী কাজ হবে।”
তিনি জানান, “পাঠ্যপুস্তকের বড় কোনও ভুল ধরা পড়েনি। ভুলের বিষয়টি পুরোপুরি চিহ্নিত হওয়ার পর আমরা ওই পাতাগুলোকে কারেকশন করে সমস্ত জায়গায় পাঠিয়ে দেবো। তখন শ্রেণি-শিক্ষকরা ওটা প্রতিস্থাপন করে দিবেন বইয়ের আগের জায়গায়।”
সম্পাদনা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলম বলেন, “আমাদেরকে যদি ডাকা হয়, তখন আমরা বলব ঠিক কী হয়েছে। তখন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে অনেক তথ্যই সংশোধন করা হবে।”
তবে এটি নিয়ে যে এক ধরণের সংকট তৈরি হয়েছে তা মানছেন সম্পাদনা পরিষদের সদস্য আবুল মোমেন। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব সংশোধন করার পাশাপাশি নতুন একটি সুপারিশও তিনি দেবেন বলে জানাচ্ছেন।
মোমেন বলেন, “ইসরায়েল রাষ্ট্র অরিজিনালি ছিলো প্যালেস্টাইন। কীভাবে এর উৎপত্তি হল, এটা নিয়ে একটা অধ্যায় আমরা যোগ করতে পারি। নতুন একটা লেখা দিয়ে এই ইতিহাসটা যোগ করতে পারি, এটাই আমার সুপারিশ থাকবে। ফিলিস্তিন যে বঞ্চিত হয়েছে এটা ওদের কাছে ক্লিয়ার করে দেওয়া দরকার”।
পাঠ্যপুস্তকে কত ভুল?
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে গত বছর পাঠ্যপুস্তকে চারশোর অধিক ভুলভ্রান্তি সংশোধন করা হয়েছে। দুটি বই প্রত্যাহারও করা হয়েছে, যেখানে খরচ হয়েছে ২৩ কোটি টাকা। এ বছর সরকার ৩ কোটি ৮১ লাখ ২৮ হাজার ৩২৪জন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭ কপি নতুন বই বিতরণ করেছে, যার ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৪০০ কোটি টাকা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষা গবেষক নাসরিন সুলতানা বলেন, “তাড়াহুড়ো করে নতুন নতুন পাঠ্য বই আনা হচ্ছে। প্রতিটি পাঠ্য বইয়েই কোনও না কোনও ভুল পাওয়া যাচ্ছে। । বাচ্চারা তো গিনিপিগ না। শিশুদের ওপর পরীক্ষা চালানো হচ্ছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, “যারা নীতি নির্ধারণ ও তার বাস্তবায়নে আছেন তাদের সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা খুবই দুর্বল। এই ধরনের ভুল থাকার পরও বইগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া খুবই বিপদজনক।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার পরিচালনায় যারা আছেন তাদের প্রজন্ম ও মানুষের প্রতি কোনও দায় যে নেই, এই ভুলগুলোর মধ্যে দিয়ে তারা সেই উদাহরণগুলোই তৈরি করছেন। এগুলো মেনে নেওয়া সত্যিই কঠিন।” সূত্র : বিবিসি বাংলা।