নির্বাচন এলেই নগরজুড়ে কানে আসে দারুণ সব স্লোগান। এসব স্লোগানের একটি “সিল মারো ভাই সিল মারো….”। এই স্লোগানটি এবার আর কাজে আসবে না চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী–বাকলিয়া) আসনে।
কারণ এই আসনে ভোটারদের ভোট দিতে গেলে আর সিল মারতে হবে না। ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করা হবে এই আসনে।
বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থায় ভোটাররা বুথে ভোট দিতে গেলেই ধরিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন মার্কা সম্বলিত এক লম্বা ব্যালট পেপার। ওই পেপারে থাকা পছন্দের মার্কার উপর কালি মাখানো সিল মারতে হতো ভোটারদের। তারপর লম্বালম্বি অবস্থায় ভাঁজ করে তা ফেলতে হতো নির্ধারিত বক্সের মধ্যে। যদি কেউ ভুল করে এই ব্যালট আড়াআড়ি ভাঁজ করে ফেলে তাহলে তাঁর ভোট বাতিল। কারণ আড়াআড়ি ভাঁজ করলে সিলের ছাপ পড়বে তার নিচের মার্কায়ও। দুইটি মার্কায় সিলের ছাপ পড়লে নষ্ট হবে ব্যালট।
এছাড়া এই পদ্ধতিতে ভোট দিতে গড়ে সময় লাগে তিন থেকে পাঁচ মিনিট। একজনের ভোট আরেকজনের দেওয়ার অভিযোগও থাকে হরহামেশা। এসব জটিলতা থেকে উত্তরণে ইভিএম পদ্ধতিকে বাছাই করেছে নির্বাচন কমিশন। এ পদ্ধতিতে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডেই নিজের পছন্দের মার্কায় ভোট দিতে পারবেন ভোটাররা।
তবে ভোট প্রদানের নতুন এ পদ্ধতি নিয়ে ভোটারদের মধ্যে যেমন রয়েছে কৌতূহল, তেমন রয়েছে প্রশ্ন, শংকা।
বিশেষ করে তরুণ ও নবীন ভোটাররা প্রযুক্তির সহায়তায় ভোট দেওয়া নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও অধিকাংশ বয়োজ্যেষ্ঠ ভোটার এ ব্যবস্থা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আবার কেউ কেউ করছেন বিরোধীতা। অনেকে আবার ইভিএম নিয়ে প্রচার ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার দাবি জানান।
চট্টগ্রাম জেলা নিবার্চন কর্মকর্তা মুনির হোসেন খান জয়নিউজকে বলেন, সিটি করপোরেশনের ৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪ ও ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে চট্টগ্রাম-৯ সংসদীয় আসনটি গঠিত।
এই আসনের ১৪৪টি ভোটকেন্দ্রে মোট দুই লাখ ৩৯ হাজার ৯১৪ জন ভোটার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে (ইভিএম) ভোট দেবেন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৩০ হাজার ১৪৭ জন এবং নারী ভোটার এক লাখ নয় হাজার ৭৬৭ জন।
নগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ফারুক জয়নিউজকে বলেন, ইভিএম-এর মাধ্যমে দ্রুত ভোট দেওয়া যাবে। আবার ভোট কারচুপি হওয়ারও কোন সুযোগ নেই। বর্তমানে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ সারা বিশ্বে প্রশংসিত।
চট্টগ্রাম নগর বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ইদ্রিস আলী জয়নিউজকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্বল্প পরিসরে যে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে তাতে কোনো জায়গায় ইভিএম কখনও কখনও বন্ধ হয়ে গেছে। একজনের ভোট আরেকজন দিয়েছে। কোথাও ইভিএম বাদ দিয়ে ব্যালট পেপারেও ভোটগ্রহণ করতে হয়েছে। এছাড়া ইভিএমে সহজেই কারসাজি করা যায়। অসাধু প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের মাধ্যমে যেকোনো প্রার্থীর পক্ষে সহজেই ভোট জালিয়াতি করা সম্ভব। বিএনপির পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম-৯ আসনে ইভিএম বন্ধ করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে লিখিতভাবে আহ্বান জানানো হবে। আমার বিশ্বাস আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করতে জানেন না।
চকবাজার ওয়ার্ড কমিউনিটি পুলিশিং-এর সাধারণ সম্পাদক ও তরুণ উদ্যোক্তা জসিম উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে দেশ এখন ডিজিটাল যুগ অতিক্রম করছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে এখন প্রযুক্তির ছোঁয়া বিদ্যমান। অফিসিয়াল হাজিরা থেকে শুরু করে সিম রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে শুরু করে যেকোনো সরকারি-বেসরকারি অফিসের আভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে। এতে কমেছে ভোগান্তি, বেঁচে যাচ্ছে সময়, অর্থ। সারাবিশ্বে ইভিএম একটি গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় ভোটপদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ভোট নষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কয়েক সেকেন্ড ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে ভোটারদের সময়ক্ষেপণও করতে হবে না। তাই এ পদ্ধতিকে স্বাগত জানানো উচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাকলিয়া এলাকার এক স্কুলশিক্ষিকা জয়নিউজকে বলেন, ‘আমি বেশ কয়েকটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছি। একজন ভোটার ব্যালটে সিল মারার পর নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেন ভোটটি তাঁর পছন্দের প্রার্থীই পাচ্ছেন। কিন্তু প্রথমবার ইভিএমে ভোট দিতে গেলে ভোটারের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তাঁর পছন্দের প্রার্থী ভোটটি পাচ্ছেন তো? কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরকম সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। আমার জানামতে এই সিস্টেমে ভোট কারচুপির কোন সুযোগ থাকবে না।
তিনি আরো বলেন, ইতিপূর্বে দেখা গেছে ব্যালটের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ শেষে গণনার সময় ভোটার পছন্দের একটি প্রতীকে সিল মারতে গিয়ে কয়েকটি প্রতীকে সিল মেরেছেন। এমনকি দুই প্রতীকের মাঝখানেও সিল মারতে দেখা যায়। সিলের কালি অস্পষ্ট থাকে। এরকম নানা ত্রুটির কারণে অনেক ভোট নষ্ট হয়। কিন্তু ইভিএম পদ্ধতিতে সে সুযোগ নেই। এখানে একজন ভোটার শুধুমাত্র একটি ভোট প্রদানের সুযোগ পাবেন। প্রতীক দেখে ভোটার তার পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিতে পারবেন। তিনি আরো বলেন, অনেক সময় ভোটের বাক্স চুরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে কিন্তু এই পদ্ধতিতে কোন সুযোগ থাকবে না।
নগরের দেওয়ানবাজার এলাকার ভোটার আব্দুল মান্নান জয়নিউজকে বলেন, আগে কখনো ইভিএমে ভোট দেইনি। এবারই প্রথম এই পদ্ধতিতে ভোট দেবো। হঠাৎ ইভিএম ভোট দেওয়াটা কেমন জানি লাগছে।
আনোয়ার হোসেন রনি নামে নন্দনকানন এলাকার এক ভোটার জয়নিউজকে বলেন, পত্রিকা থেকে জেনেছি জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্টকার্ড ছাড়াও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তাঁর আঙুলের ছাপে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যালট ইস্যু করতে পারবেন। এ অবস্থায় ভোট যে শতকরা শতভাগ নির্ভেজাল থাকবে, তার নিশ্চয়তা কী?
জানা গেছে, এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। অন্যদিকে বিএনপি থেকে প্রার্থী হতে পারেন দলটির নগর কমিটির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সামসুল আলম ও যুগ্ম সম্পাদক এস এম সাইফুল আলমের যেকোন একজন।
প্রসঙ্গত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ৬টি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ করা হবে। আসনগুলো হলো ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, চট্টগ্রাম-৯, খুলনা-২, রংপুর-৩ ও সাতক্ষীরা-২। সোমবার (২৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশন ভবনে লটারির মাধ্যমে এই ছয়টি আসন নির্ধারণ করা হয়।