মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে বেশিরভাগ মাদক ঢুকে বাংলাদেশে। এরপর এ জেলা থেকে সারাদেশে মাদক ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে সড়কপথে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় যেতে একাধিক স্থানে তল্লাশির মুখে পড়তে হয় যাত্রীদের। আকাশপথে যাতায়াতকারীরাও থাকেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারিতে। সমুদ্র পথে মাদক পাচার ঠেকাতেও সক্রিয় সংশ্লিষ্টরা।
কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন রেলপথে কক্সবাজার থেকে রাজধানীর উদ্দেশ্যে যাতায়াতকারীরা। সম্প্রতি দেশের রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। এ কারণে রেলপথে মাদকের চোরাচালান ঠেকাতে এখনো তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, যাতায়াতের সুবিধা ও পরিবহনে কম খরচ হওয়ার কারণে সড়কপথেই বেশিরভাগ মাদক পাচার হয়। এছাড়া আকাশপথ ও সমুদ্রপথ ব্যবহার করেও মাদকের চোরাচালান হয়ে থাকে। এই তিন পথে গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি কখনো পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), আবার কখনো র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কিংবা কোস্ট গার্ড মাদক উদ্ধার করে থাকে।
এরই মধ্যে গত বছরের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রেলপথের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর ১ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে সরাসরি ও কক্সবাজার পর্যন্ত ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ নামে বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হয়। গত ১ জানুয়ারি থেকে ‘পর্যটক এক্সপ্রেস’ নামে একই রুটে আরেকটি ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এরপর থেকে এ রুটে এক জোড়া ট্রেন প্রতিদিন চলাচল করছে। একেকটি ট্রেনে বিভিন্ন শ্রেণি মিলিয়ে আসন রয়েছে প্রায় ৭৮০টি। এ হিসাবে দুটি ট্রেনে প্রতিদিন দেড় হাজারের বেশি যাত্রী কক্সবাজার থেকে ঢাকা যাতায়াত করছেন। ট্রেন দুটি বিরতিহীন হওয়ার কারণে চট্টগ্রামে ইঞ্জিন বদল করা ছাড়া কোনো স্টেশনে থামে না। এর ফলে ট্রেন দুটি দিয়ে যাতায়াতকারীরা কোথাও তল্লাশির মুখে পড়ে না।
আবার কক্সবাজারের মূল স্টেশনটি দৃষ্টিনন্দন করে বানানো হয়েছে। আইকনিক এ রেলস্টেশনে নানা অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকলেও মাদক শনাক্তে নেই ড্রাগ ডিটেকটিং স্ক্যানার কিংবা এক্সরে মেশিন। এছাড়া মাদক শনাক্ত করতে সক্ষম ডগ স্কোয়াডও নেই স্টেশনটিতে। ফলে গতানুগতিক পদ্ধতিতে সেখানে তল্লাশি করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সংস্থার জনবল সংকটের কারণে অনেক সময় তল্লাশি করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এ অবস্থায় কক্সবাজার থেকে রেলপথে মাদক চোরাচালান ঠেকাতে বিশেষ পরিকল্পনা নিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে সংস্থাটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়। এতে কক্সবাজারে বিশেষ জোন করে প্রয়োজনীয় জনবল ও সরঞ্জাম সরবরাহ করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাফরুল্লাহ কাজল বলেন, বিশেষ জোনের জন্য একজন সহকারী পরিচালকসহ ৩২ জন জনবল, একটি ডাবল কেবিন পিকআপ, যাত্রীদের তল্লাশির জন্য পোর্টেবল ও আধুনিক ড্রাগ ডিটেকশন স্ক্যানার ও এক্সরে মেশিন, প্রশিক্ষিত ডগ স্কোয়াড চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় ট্রেনে যাতায়াতকারীদের বাধাহীনভাবে তল্লাশি করতে সহযোগিতা চেয়ে রেলওয়েকে চিঠি দিয়েছে।
এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজার দীর্ঘদিন ধরে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে ইয়াবা, আইসসহ বিভিন্ন ভয়াবহ মাদক পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কক্সবাজার থেকে এসব মাদক নিত্যনতুন কৌশলে সড়ক, নৌ ও আকাশপথে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। সড়কপথে মাদক পাচাররোধে টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কে পুলিশ, বিজিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৮-১০টি চেকপোস্ট স্থাপন করেছে। এসব চেকপোস্টে নিয়মিত যাত্রীবাহী বাসসহ সব যানবাহন তল্লাশি করা হচ্ছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়, জেলা কার্যালয় ও গোয়েন্দা কার্যালয় ২০২২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দুই বছরে ২ হাজার ৯৩৭টি মামলায় ৩ হাজার ১৮৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। যার মধ্যে ৯৬৯টি মামলা চেকপোস্টের মাধ্যমে হয়েছে। এসব মামলায় ১ হাজার ৩৩ জনকে ২০ লাখ ৬২ হাজার ৯৪২ পিস ইয়াবা, ১ কেজি হেরোইন, ২ গ্রাম আইস, ৪২০ লিটার চোলাই মদ, ১০টি সোনার বারসহ আটক করা হয়। এছাড়া মাদক পরিবহনে ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস, একটি মিনিবাস ও একটি মিনিট্রাক জব্দ করা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রোর (উত্তর) উপ-পরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার বলেন, কক্সবাজার-ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচল শুরুর পর থেকে সড়কপথে মাদক পরিবহন অনেক কমে গেছে। আগে যারা সড়কপথ ব্যবহার করত তারা এখন রেলপথ ব্যবহার করছে, এমন তথ্য আমাদের কাছে আছে। এ কারণে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেলওয়েকে ঘিরে বিশেষ জোন করার জন্য অধিদপ্তরে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।
কক্সবাজার-ঢাকা রুটে মাদক চোরাচালানের বিষয়ে রেলওয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) প্রকৌশলী হাছান চৌধুরী বলেন, রেলযোগে কক্সবাজার থেকে মাদক পাচার ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। রেলওয়ে পুলিশ সদস্যরা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশির পাশাপাশি গোয়েন্দা সদস্যরা রেল ছাড়ার আগে কঠোরভাবে নজরদারি চালাচ্ছে। তবে জনবল সংকটের কারণে অনেক সময় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।
জেএন/এমআর