খাতুনগঞ্জে মূল সড়ক একটিই। প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কটির প্রশস্ততা বিশ ফুট। একদিন সড়কটির উত্তর পাশের দশ ফুট দখলে থাকে তো পরদিন দখলে চলে যায় দক্ষিণ পাশের দশ ফুট। পালাবদলের মাধ্যমে সড়ক দখল করেই দেশের সর্ববৃহৎ খাদ্যপণ্যের পাইকারী বাজারে গড়ে তোলা হয়েছে এই পার্কিং ব্যবস্থা! পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে ‘আজ এ পাড়ে, কাল ওই পাড়ে’হিসেবে গাড়ি পার্কিং করেন ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জে চব্বিশ ঘণ্টায় ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, মিনিট্রাক প্রবেশ করে হাজারের বেশি। টেরিবাজার রোড হয়ে প্রবেশ করে এসব যানবাহন বের হয় চাক্তাই মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে। যে বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ব্যবসা হয় শত কোটি টাকার, সেখানকার যানজট নিরসনে নেই একজন ট্রাফিক পুলিশও! ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে ৭ জন গার্ড এই বিশাল এলাকার যানজট নিরসনের দায়িত্ব পালন করছেন। শত শত ভবনের কোনটিতেই রাখা হয়নি নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, টেরিবাজার রোড দিয়ে খাতুনগঞ্জে প্রবেশ করে ট্রাক-কাভার্ডভ্যানগুলো পার্কিং করা হচ্ছে ওই বিশ ফুটের মূল সড়কেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে এসব যানবাহনে চলে পণ্য ওঠানামা। গাড়ির পেছনে গাড়ি দাঁড়িয়ে থেকে লাইন চলে যায় খাতুনগঞ্জ পেরিয়ে চাক্তাই এলাকা পর্যন্ত। ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু খালি অংশ রয়েছে তাতে পণ্য ওঠানামার পর তা পরিবহনের জন্য আসা যাওয়া করে শত শত ঠেলাগাড়ি। একপাশ দখলে থাকাই নিয়মে পরিণত হয়েছে এ সরু সড়কটির। অথচ যানজট নিরসনে ব্যবসায়ীরাই নিয়ম করেছেন, দিনের বেলা ট্রাক-কাভার্ডভ্যান প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু এ নিয়মকে মানছেন না কেউ। ফলে সময় নষ্টের পাশাপাশি যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে পণ্য। ব্যাহত হচ্ছে পণ্যের সরবরাহ। এতে প্রভাব পড়ছে পণ্যের দামে।
এন আলম এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার শুভ দাশ জানান, নিয়ম মেনে দিনের বেলা ট্রাক প্রবেশ বন্ধ রাখা যেত। কিন্তু সে নিয়ম মানার সুযোগ কম। কারণ যখনই ট্রাক আসছে তখনই পণ্য খালাস করা থাকে ব্যবসায়ীদের মূল টার্গেট। তাই যানজটের দিকে কেউ খেয়াল করেন না। যানজটকে এখানে বাণিজ্যের জৌলুসও মনে করেন অনেকে।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২০০৩ সাল পর্যন্ত খাতুনগঞ্জে পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। এরপর কী কারণে এই ফাঁড়ি তুলে ফেলা হয়েছে তা জানি না। এখন তাই বাধ্য হয়ে যানজট নিয়ন্ত্রণে লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সাত জন সকালে ও আট জন রাতে যানজট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকে। কিন্তু পেশাদার লোক না হওয়ায় তাদের পক্ষে যানজট নিয়ন্ত্রণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। ট্রাফিক পুলিশ নিয়োজিত থাকলে এ যানজট অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতো।
চাক্তাই, আছাদগঞ্জ, রাজাখালী এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত খাতুনগঞ্জের পাইকারী বাজার। কতটি ভবনে কয় হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার কোন হিসেব নেই কোন সংস্থার কাছে। পণ্যভেদে এখানে বেশ কিছু সংগঠন গড়ে উঠেছে। তাদের কাছেও প্রতিষ্ঠানের কোন হিসেব নেই। দেশের প্রায় সবকটি ব্যাংকের শাখাও রয়েছে খাতুনগঞ্জে। ব্যবসায়ীরা জানান, শত শত ভবনে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সবগুলো ভবনই অনেক পুরানো। এসব ভবনের কোনটিতেই নেই পার্কিং ব্যবস্থা। ফলে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ, ঠেলাগাড়ির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান মালিক ও বাণিজ্য সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিগত গাড়িও পার্কিং করতে হয় এই সরু সড়কেই। বাধ্য হয়েই ব্যবসায়ীরা পালাবদল করে সড়কটির অর্ধেক রাস্তা পার্কিং হিসেবে ব্যবহার করছেন।
দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীরা খাতুনগঞ্জে একটি ট্রাক টার্মিনাল করার দাবি জানিয়ে আসলেও তা বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
এ বিষয়ে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি সোলায়মান বাদশা বলেন, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ের একমাত্র বাধা হচ্ছে যানজট। পণ্য নিয়ে আসা ট্রাকগুলোর কারণে যানজট সৃষ্টি হয়। যানজটের কারণে চলে গেছে অনেক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। কর্ণফুলী নদীর পার দিয়ে নতুন রাস্তার পাশে টার্মিনাল করার আবেদন করেছিলাম চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু এখনও এ টার্মিনাল না হওয়ায় ভোগান্তির স্বীকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ টার্মিনাল বাস্তবায়ন হলে চাক্তাই খাতুনগঞ্জের চিত্র বদলে যাবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) কুসুম দেওয়ান জয়নিউজকে বলেন, খাতুনগঞ্জ এলাকায় পুলিশের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও প্রাইম মুভারসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির যানবাহনের জন্য পৃথক টার্মিনাল তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে এ বিষয়টির এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। জনবল সংকট থাকায় ওই এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করা যাচ্ছে না। চাহিদা অনুযায়ী জনবল বৃদ্ধি পেলে খাতুনগঞ্জে পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করা হবে।