চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) নির্মানের জন্য জমি অধিগ্রহণ করার ৭৩ বছর পরও নিজেদের নামে বরাদ্দ দেয়া জমি বুঝে পায়নি তিনটি মালি পরিবার। নিজেদের মাথাগোঁজার ঠাঁই হারিয়ে তিন পরিবারের সদস্যরা ভ্রাম্যমান মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
জানা যায়, ১৯৫০ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ নির্মাণকালে অন্যান্য আরো অনেক মৌজার সাথে পাঁচলাইশ থানার নিজ শহর মৌজা হতে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল।
অধিগ্রহণকালে কমল চন্দ্র মালী ওরফে কমল চন্দ্র দাশের প্রায় এক একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। উক্ত অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রন্থ পরিবারগুলোকে পূর্ণবাসনের জন্য ৩৫/৫০—৫১ নং এল.এ কেস মূলে পূর্ব নাসিরাবাদ মৌজায় জমি অধিগ্রহণ করে তৎকালীন সরকার।
যা প্লট বরাদ্দের তালিকায় ১৯৫৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের ১২৯২ এলএ নং স্বারকে মনমোহন মালী, কমল চন্দ্র মালী ও কেশব চন্দ্র মালীর নামে বরাদ্দ রয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক হানাদার বাহিনীর দেয়া আগুনে পুড়ে বরাদ্দকৃত প্লট গ্রহিতা কেশব চন্দ্র মালী এবং নির্মল চন্দ্র মালী নিহত হয়।
এদিকে ১৯৯১ সালে মনমোহন মালিও মারা গেলে স্থানীয় সুবিধাবাদী জবরদখল কারীদের তান্ডবে প্লটছাড়া হয়ে পাশ্ববর্তী ভাড়া বস্তিতে মানবেতর দিনযাপন করতে থাকে অসহায় পরিবারগুলোকে।
পিতার মৃত্যুর কারণে তাদের কাছে অন্য কোন বরাদ্দ পত্র না থাকায় বিপাকে পড়েন অন্যান্য ওয়ারিশগণ। ফলে রেকর্ড সন্ধানে ২০০৯ সালের ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনে খোঁজ খবর নেন মনমোহন মালির ছেলে রূপন চন্দ্র দাশ।
রূপন চন্দ্র জানায়, রেকর্ড থেকে প্রদত্ত সন্ধানে উল্লেখ করা হয় এল এ মামলা নং ০৫/৫০-৫১ মৌজা পূর্ব নাছিরাবাদ, থানা-পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম পাশে চাহিত সংবাদের মর্মমতে পর্যালোচনা করে দেখা যায় তফশিল স্বারক নং ৮৬/এল এ তাং ১১/০৯/১৯৯৭ মূলে পূর্নবাসনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত তালিকায় আবেদনে বর্ণিতদের নামে ০.৩০ একর সেক্রেটারিয়েল এসোসিয়েশন কর্তৃক অনুমোদিত ভূমি বরাদ্দ রয়েছে।
এই ধারাবাহিকতা উপরোক্ত প্লট হস্তান্তরের জন্য ২০১০ সালের ১৯ জুলাই গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর কাছে আবেদন করি।
আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ২৩ নভেম্বর গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীকে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রদানের নির্দেশ দেন।
নির্দেশের ভিত্তিতে গণপূর্ত বিভাগ চট্টগ্রাম (স্বারক নং ১৬১৫/২(২) গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পদত্ত পত্রে সরেজমিনে প্রতিবেদন তৈরি করেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নাছিরাবাদ পূর্ণবাসন এলাকায় ৬৮,৯৯,১০০ নম্বর প্লটের ০.৩০ একর ভূমি রূপন চন্দ্রের পিতা মনমোহন মালি, কমল চন্দ্র মালি ও কেশব চন্দ্র মালীর নামে বরাদ্দ রয়েছে।
চট্টগ্রামস্থ পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা এবং মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৩৫/৫০-৫১নং এল এ মামলার মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত যে সকল পরিবারের ষোলশহর পূর্নবাসন এলাকায় জমি বরাদ্দ/বন্দোবস্ত প্রদানের আবেদন রয়েছে।
সে সকল আবেদন নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের নিমিত্ত গঠিত কমিটির সভা ২০১৪ সালের ২০ এপ্রিল গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (উন্নয়ন ২) এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় (ক) ৩৫/৫০—৫১ এল এ মামলায় ক্ষতিগ্রস্থদের জমি অধিগ্রহনের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল তাদের এওয়ার্ড লিস্ট পরীক্ষা করে একটি তালিকা প্রস্তুত করতে এডিসি (এল এ) চট্টগ্রামকে নির্দেশ দেয়া হয়।
একই সভায় নির্বাহী প্রকৌশলী গণপূর্ত বিভাগ চট্টগ্রামের এর কার্যালয়ের ৮৭টি ফাইল পরীক্ষা নিরীক্ষাপূর্বক সরজমিনে যে সকল পরিবার পূর্নবাসন এলাকায় বসবাস করছে তাদের সাথে মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশ দেয়া হয়।
তাছাড়া তালিকাসহ প্রতিবেদন পাওয়ার পর উক্ত কমিটি সরেজমিন উপস্থিত হয়ে আবেদনকারীদের কাগজপত্র পরীক্ষা ও শুনানী করার সিদ্ধান্ত হয় ওই সভায়।
কিন্তু সভার ৭ বছর পরও কোন সুরাহা না হওয়ায় ২০২১ সালের ১৭ আগষ্ট রূপন চন্দ্র দাশ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সচিব বরাবরে আরো একটি আবেদন করেন।
ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০২২ সালের ৮ আগষ্ট চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগ নং ১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ ছয় পৃষ্ঠার প্রতিবেদন তৈরি করেন।
এতে রুপন চন্দ্রের পিতাদের নামে পূর্ব নাছিরাবাদ মৌজার আর এস ১৬২৩ (অংশ) ১৬২৫ (অংশ) ১৬৫০ অংশে দাগের আন্দর ৬৮,৯৯,১০০ নম্বর প্লটে ০.৩০ একর ভূমি বরাদ্দের সুপারিশ রয়েছে।
ইতোমধ্যে ৬৮ নম্বর প্লটটি অন্য কাউকে বরাদ্দ দেয়ায় এই মৌজার উল্লেখিত দাগাদির আন্দর ৯৮,৯৯,১০০ নম্বর প্লটে আমার তার পরিবার দীর্ঘদিন বসবাস করেছে।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয় চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে প্রতিবেদন দেয়ার দেড় বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে উক্ত প্লট বুঝিয়ে দেয়া হয়নি।
এই বিষয়ে সবাক এর চট্টগ্রাম সভাপতি অ্যাডভোকেট আক্তার কবির চৌধুরী বলেন, অসহায় সাধারণ মানুষ রাস্ট্র থেকে ন্যায্য সুবিধা পাওয়াটা কত কঠিন এটা তার উদাহরণ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ স্থাপন করার জন্য জমি অধিগ্রহণের ৭৩ বছর পরও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো ঠিকানাহীন। যা সত্যি দুঃখজনক।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো বর্ষিয়ান সাংসদ একাধিক পত্র দেওয়ার পরও কেন তা বাস্তবায়িত হয়নি তা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে তিনি জানান।
জেএন/পিআর