চট্টগ্রামে উপজেলা সদর এলাকা ও মহাসড়কের আশপাশে নির্মিত হচ্ছে আবাসিক বহুতল স্থাপনা, বাণিজ্যিক ভবন ও শিল্পকারখানা। এখানে সার্ভিস ওয়ার্টারের কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ পানির দেদার ব্যবহার চলছে। খোলা জায়গা কমে যাওয়ায় পর্যাপ্ত বৃষ্টির পানি মাটির নিচে ঢুকতে পারছে না। নলকূপ লাইসেন্সের আওতায় আনার কোনো সংস্থার তদারকি না থাকায় বেপরোয়াভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন চলছে। এতে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় চট্টগ্রামে বিভিন্ন এলাকায় হাজারো নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। এতে সুপেয় পানি নিয়ে মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় ওয়াসা সার্ভিস ওয়ার্টার সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু সার্ভিস ওয়ার্টার ব্যবস্থা থাকলেও নগরীর প্রতিটি ভবনে ব্যক্তিগতভাবে গভীর নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার চলছে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা থাকলেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপজেলা সদরের পৌর এলাকায় সার্ভিস ওয়ার্টার সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে। পৌরসভা এই উদ্যোগ নিতে পারে।
চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও সার্ভিস ওয়ার্টার সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। সম্প্রতি বাঁশখালী ও চন্দনাইশ পৌর এলাকায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দুটি সার্ভিস ওয়ার্টার প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে। শিল্পায়ন ও ব্যবসার প্রসারের কারণে জেলার উপজেলা সদর এলাকায় ব্যাপক হারে বহুতল স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে। সদর এলাকায় হচ্ছে ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা, হাসপাতাল ক্লিনিক, বিপনিকেন্দ্র, আবাসিক বহুতল ভবনসহ নানা স্থাপনা। কিন্তু সার্ভিস ওয়ার্টারের ব্যবস্থা না থাকায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানীয় ও ব্যবহারের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির দেদার উত্তোলন হচ্ছে। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য নলকূপের লাইসেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। এতে দেখা যায়, শুষ্ক মৌসুমে জেলার বিভিন্ন স্থানে সুপেয় পানির সংকট দেখা দেয়। অনেক এলাকায় নলকূপে পানি মেলে না।
চট্টগ্রাম প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুদীপ কুমার পাল বলেন, যেখানে ওয়াসার পানি সরবরাহ নেই, সেখানে মানুষ ভূগর্ভস্থ পানির দিকে ঝুঁকছে। পৌর এলাকায় নলকূপের লাইসেন্স নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও মানুষ মানছে না। ভূগর্ভস্থ উত্তোলিত সমপরিমাণ পানি খোলা জায়গা কমে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি মাটির নিচে ঢুকতে পারছে না। পৌরসভাগুলো চাইলে নিজ উদ্যোগে সার্ভিস ওয়ার্টারের ব্যবস্থা করতে পারে।’
চট্টগ্রামে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলার পটিয়া, কর্ণফুলী উপজেলা, সীতাকুণ্ডু, মীরসরাই, লোহাগাড়া, আনোয়ারাসহ টানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। কর্ণফুলী ও সীতাকুণ্ডু এলাকায় গভীর নলকূপে পানি মিলছে না। যেভাবে দেদার ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন চলছে, ভবিষ্যতে সুপেয় পানি নিয়ে মানুষকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে। জেলায় অবস্থিত একটি বড় শিল্পকারখানায় তিন থেকে চারটি করে গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি উত্তোলন চলছে।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল চট্টগ্রামের নির্বাহী পলাশ চন্দ্র দাশ বলেন, ‘খাবারের জন্য খুবই কম পরিমাণ পানির ব্যবহার হয়। ফলে সরকারি এসব নলকূপে ভূগর্ভস্থ পানির ক্ষতি হচ্ছে না। তবে কৃষিকাজে ও শিল্পকারখানায় ভূগর্ভস্থ পানির বেশি ব্যবহার হচ্ছে। তার প্রভাব পড়ছে পানির স্তরে। সরকার প্রকল্পের মাধ্যমে পানি পরিশোধন করে উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে বিকল্প উৎস নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের সমুদ্র, নদী, খালের পানি রয়েছে। এসব পানি পরিশোধনের মাধ্যমে ব্যবহারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। না হয় অচিরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে সুপেয় পানির চরম সংকট দেখা দেবে। জানতে চাইলে চুয়েটের সাবেক ভিসি ও চট্টগ্রাম ওয়াসা পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শহরে গ্রামে পাকা দালান নির্মাণের কারণে বৃষ্টির পানি মাটির নিচে প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরাসরি নদী খালে চলে যাচ্ছে। আমাদের ভূওপরিস্থ পানির ব্যবহার নিয়ে ভাবতে হবে। কক্সবাজারে ইনানি বিচের পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ। সেখান থেকে পানি উত্তোলন করে পরিশোধন করলে পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামে সরবরাহ করা যাবে। লবণাক্ততা পানি পরিশোধন নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশে সমুদ্রের পানি পরিশোধন করে ব্যবহার হচ্ছে। পরিশোধনের বিদ্যুত্খরচ বেশি লাগে। এক্ষেত্রে সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে খরচ অনেক কম হবে।’
জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা জানান, প্রতি বছর তিন থেকে চার ফুট করে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। আগে যেখানে ২০ ফুট নিচে গিয়ে পানি পাওয়া যেত, এখন ৩৫/৪০ ফুট নিচে যেতে হচ্ছে। উপজেলায় ২৫ শতাংশ নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে।
কর্ণফুলী উপজেলার উপসহকারী প্রকৌশলী নাজিম উদ্দিন রাসেল বলেন, ১০০ থেকে ১৫০ ফুট গভীরের যেসব নলকূপ রয়েছে, তাতে আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। শিল্পকারখানাগুলোতে প্রতিটিতে একাধিক গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। কিছু এলাকায় অনেক গভীরে গিয়েও পানীয় উপযোগী পানি মিলছে না। কিছু এলাকায় ৫০০ থেকে ৬০০ ফুট গভীরে যেতে হচ্ছে।’ আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর, দক্ষিণ গহিরা, পূর্বগহিরা, সরেঙ্গা, উত্তর পরুয়াপাড়া সুপেয় পানির চরম সংকট বিরাজ করছে। সাগর উপকূলীয় হওয়ায় পানিতে লবণাক্তা বেশি। জোয়ারের সময় পুকুরগুলোতে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে।
জেএন/এমআর