রাজধানীর বেইলি রোডে অবস্থিত গ্রিন কোজি কটেজ ট্র্যাজেডির পর অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ে টনক নড়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও। অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত বন্দরনগরী তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শহরজুড়ে ১৭৩টি ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো হলেও সেগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে। এ নিয়ে টানা-হেঁচড়া চলছে ওয়াসা ও ফায়ার সার্ভিসের মধ্যে।
২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অগ্নিনির্বাপণের সুবিধার্থে ১৭৩টি ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো হয় চট্টগ্রাম নগরজুড়ে। কিন্তু ২ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো অব্যবহৃত পড়ে আছে। বারবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটলেও একবারের জন্যও সেগুলো ব্যবহার হয়নি। স্থানীয়রা বলছেন— চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) কর্তৃক স্থাপিত ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে কোনো কাজেই আসছে না।
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে— ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো যথাযথ নিয়মে স্থাপন করা হয়নি। সাধারণ পানির লাইনের উপর হাইড্রেন্ট বসানো হয়েছে। আগুন নির্বাপণে যে পরিমাণ গতির পানি দরকার, সেরকম গতির পানি হাইড্রেন্টে পাওয়া যাবে না। ফায়ার হাইড্রেন্টের জন্য পানির আলাদা লাইন দরকার, সেটিও ওয়াসা করেনি। ফায়ার এক্সপার্টদের পরামর্শ ছাড়াই এসব বসানো হয়েছে।
তবে ওয়াসা বলছে— ফায়ার সার্ভিসের পরামর্শে বিভিন্ন জায়গায় ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো হয়েছে। পরবর্তীতে এগুলোর দায়িত্ব ফায়ার সার্ভিসের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ দাবি করছে— হাইড্রেন্টগুলো তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।
চট্টগ্রাম ওয়াসা থেকে জানা যায়, ওয়াসার দুটি পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় এসব ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হয়েছে। মূলত এ দুটি প্রকল্পে বিনিয়োগকারী দাতা সংস্থার শর্ত পূরণ করতেই ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ২০১৯ সালের শুরুতে ‘চিটাগাং ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রজেক্ট’-এর আওতায় ২৯টি হাইড্রেন্ট বসানো হয়। পরে ২০২২ ও ২০২৩ সালে ‘কর্ণফুলী ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট’ ফেজ-২ এর আওতায় আরো ১৪৪টি ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হয়।
চট্টগ্রাম শহরে গত চার দশকে প্রায় ২৪ হাজার পুকুর, দীঘি, জলাশয় ও জলাধার বিলুপ্ত হয়েছে। একসময় আগুন নেভাতে পানির উৎস ছিল এসব জলাধার। এখন শহর এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে পানির উৎস নিয়ে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে। এর ফলে আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ৬৭৮টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭ জন। ক্ষতি হয়েছে ১৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স-এর উপপরিচালক (চট্টগ্রাম) দিনমনি শর্মা বলেন, ‘ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো আমাদের পরামর্শ ছাড়াই বসানো হয়েছে। বসানোর পর আমাদের দেখতে যাওয়ার জন্য বলেছে তারা (ওয়াসা)। ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো বসানো হয়েছে সার্ভিস লাইনের উপর। কিন্তু ফায়ার হাইড্রেন্টের জন্য আলাদা লাইন দরকার। কারণ স্বাভাবিক লাইনে পানির গতি থাকে ১.৫। আর আগুন নিয়ন্ত্রণে আমাদের সর্বনিম্ন গতি ৪ দরকার হয়। অনেক সময় ১০ স্পিডের পানি ব্যবহার করতে হয়। সেগুলো তো আর সেখানে নেই।’
ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কাদের, হাইড্রেন্টের চাবি ফায়ার সার্ভিসের কাছে আছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে কোনো চাবি দেওয়া হয়নি। ব্যবস্থাপনার জন্যও বলা হয়নি।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্ল্যানিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন) মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘হাইড্রেন্ট স্থাপনের সময় ফায়ার সার্ভিসকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছি। ট্রায়াল রানের পর, প্রকল্পের কাজ শেষ করে হাইড্রেন্টগুলো ফায়ার সার্ভিসের কাছে হস্তান্তর করেছি। ফায়ার সার্ভিস যা বলছে, সেটি সঠিক নয়। আমাদের কাছে লিখিত ডকুমেন্টস আছে। এ বিষয়টি দেখাশোনা করছেন প্রধান প্রকৌশলী স্যার। আপনি তার সঙ্গে কথা বললে আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন।’
এ বিষয়ে জানতে ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও সাড়া মেলেনি।
ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবহার না হওয়ার জন্য দুই সংস্থার সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বন্দরনগরীর বাসিন্দা মো. ইউনুস বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে অগ্নিকাণ্ডে পানির উৎস হিসেবে ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবহার হয়। এতে আগুনের ভয়াবহতা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। চট্টগ্রামেও ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন হচ্ছে দেখে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ছিল। কিন্তু এখন সে স্বস্তি নেই। কারণ ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে না। সনাতনী পদ্ধতিতে পুকুর বা জলাশয় থেকে পানি ব্যবহার করছে ফায়ার সার্ভিস। তাহলে এত টাকা খরচ করে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর দরকার কী? কার স্বার্থে বসানো হয়েছে এগুলো?’
জেএন/এমআর