হুমকিতে নদীর জীববৈচিত্র্য!

এস আলমের পোড়া চিনির তরল বর্জ্য মিশছে কর্ণফুলীতে

রাজীব প্রিন্স:

চট্টগ্রামের কর্ণফুলিতে এস আলম সুগার মিলের আগুন ৪১ ঘণ্টা পরও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।

- Advertisement -

ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিটের সঙ্গে কাজ করছে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনী। ঘটনাটি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

- Advertisement -google news follower

বুধবার (৬ মার্চ) সকাল ৯টা পর্যন্ত এস আলম সুগার মিলের ভেতরে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। আশে পাশের আকাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুরো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জুড়ে ঝড় বইছে আলোচনা-সমালোচনার।

- Advertisement -islamibank
পোড়া চিনির গলিত পানি দুটি নালায় মিশছে-ছবি সংগৃহিত
পোড়া চিনির গলিত পানি দুটি নালায় মিশছে-ছবি সংগৃহিত

এদিকে এস আলম কারখানার গুদামে অগ্নিকাণ্ডে চিনির কাঁচা রাসায়নিকের গলিত পোড়া তরল বর্জ্য কারখানার ১ নম্বর গুদামের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে গুদামের পশ্চিম পাশের একটি নালায় গিয়ে পড়ছে।

গলিত চিনির বর্জ্য ওই নালা দিয়ে সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে মিশছে। লালচে-কালো তরল মিশে পানির রঙও বদলে যাচ্ছে। এতে কর্ণফুলী নদীর পানি এবং জীব-বৈচিত্র্যের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।

লালচে-কালো তরল মিশে বদলে যাচ্ছে পানির রঙ
লালচে-কালো তরল মিশে বদলে যাচ্ছে পানির রঙ-ছবি ফয়সাল এলাহী

তবে এস আলম কর্তৃপক্ষ দাবি করছেন আগুনে পোড়া চিনির তরল বর্জ্যগুলো তাদের নিজস্ব জমিতে ডাম্পিং করা হচ্ছে। নদীতে পড়লেও কোন ক্ষতি হবে না, কারণ এতে কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক নেই।

এস আলম সুপার রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানার গুদামে আগুনে গলে যাওয়া চিনি, কর্ণফুলী নদীতে পড়লে পরিবেশের ক্ষতি হবে কি না জানতে চাইলে বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ড. ইদ্রিস আলী জানায়, কারখানা থেকে পোড়া বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে পড়লে নদীর পানি দূষিত হবে। মৎস্য সম্পদ এবং জীব-বৈচিত্র্যেরও ক্ষতি হবে এইটা স্বাভাবিক।

এস আলম দেশের বড় একটি শিল্প গ্রুপ। তারা আগুনে পুড়ে যাওয়া সম্পদ যত সহজেই পুষিয়ে নিতে পারবে, পরিবেশের ক্ষতিটা তত সহজে পূরণ হবে না।

এ জন্য শিল্প কারখানা গড়ে তোলার আগে তাদের নিজস্ব পর্যাপ্ত ডাম্পিংয়ের জায়গা রাখার পরামর্শ দিয়ে এক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ভুমিকা রাখতে হবে জানান এ পরিবেশবিদ।

এস আলমের পোড়া চিনির তরল বর্জ্য মিশছে কর্ণফুলীতে-ছবি সংগৃহিত
এস আলমের পোড়া চিনির তরল বর্জ্য মিশছে কর্ণফুলীতে-ছবি সংগৃহিত

হালদা নদী গবেষক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়াও জানালেন, চিনির কাঁচামালের আগুনে পোড়া বর্জ্যগুলো কর্ণফুলি নদীর পানিতে গিয়ে মিশে ক্ষতি হবে।

এসব দাহ্য পদার্থে এক্সট্রা কেমিক্যাল থাকায় নদীর পানির কোয়ালিটি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি পানিতে অক্সিজেনের শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে কর্ণফুলী জোয়ার-ভাটার নদী হওয়ায় এ সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে না বললেন এ নদী গভেষক।

এ প্রসঙ্গে এস আলম গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (অ্যাডমিন) আকতার হাসান বলেন, এস আলম সুপার রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নিজস্ব একটি ডাম্পিংয়ের জায়গা রয়েছে। সেখানেই চিনির পোড়া গলিত লাভাগুলো জমা হচ্ছে। নদীতে পড়ার সুযোগ নেই।

এরপরও দীর্ঘ সময় ধরে আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ছিটানো পানির কিছু অংশ যদি নদীতে গিয়ে মিশে, তাতে নদী কিংবা জীব-বৈচিত্র্যের কোনও ক্ষতি হবে না। কারণ এতে কোনও ক্ষতিকর রাসায়নিক নেই।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানার এসব লাভা যে কর্ণফুলী নদীতে যাচ্ছে তা আমার জানা ছিল না। বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অন্যদিকে স্থানীয় এলাকাবাসীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে এসে অভিযোগ করছেন, অগ্নিকাণ্ডের পুড়ে যাওয়া অপরিশোধিত চিনির ধোঁয়ায় আশে পাশে তীব্র গন্ধ ছড়াচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের চোখও জ্বলছে।

বুধবার সকালে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া ওই কারখানায় সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গলিত অপরিশোধিত চিনির লালচে কালো কাদা।

দমকল কর্মীরা পানি যত ছিটাচ্ছে ততই ধোঁয়া ছড়াচ্ছে আশপাশে। ধোঁয়ার তীব্রতায় চোখ খুলতেই পারেছে না উপস্থিত লোকজন। খুললেই চোখ জ্বলছে।

এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান কর্ণফুলি নদীর পাড়ের ইছানগর এলাকায়।

সোমবার (৪ মার্চ) বিকাল ৩টা ৫৩ মিনিটে কারখানার একটি গুদামে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন লাগার সময় কারখানাটি চালু ছিল। সেখানে প্রায় সাড়ে ৫০০ শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। আগুন লাগার পর কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বুধবার (৬ মার্চ) সকাল ৯টা পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বর্তমানে ফায়ার সার্ভিসের ৯ ইউনিট আগুন নির্বাপণে কাজ করছে। গুদামটির চারপাশ থেকে পানি দেওয়া হচ্ছে। গুদামটির টিন খুলে ফেলা হচ্ছে।

প্রাথমিকভাবে কনভেয়ার বেল্টের ঘর্ষণজনিত তাপ কিংবা বৈদ্যুতিক শটসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা করছেন এস আলম গ্রুপের এইচ আর ম্যানেজার মোহাম্মদ হোসেন।

ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপ-সহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক জানান, চিনির কাঁচামালে দাহ্য পদার্থ থাকায় গুদামের ভেতরের আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও সময় লাগবে।

তিনি বলেন, বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে যতটুকু ফায়ার সেফটি প্রয়োজন ততটুকু এস আলম সুগার মিলে ছিল না। চারদিক থেকে বদ্ধ গুদামে উত্তপ্ত টিনের ছাদ কেটে ভেতরে ঢোকারও সুযোগ ছিল না। অল্পকিছু ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করা যায়নি।

ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক (প্রশাসন অর্থ) জসিম উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, যেখানে আগুন লেগেছে সেটিতে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি মজুত ছিল। এগুলো এক ধরনের দাহ্য পদার্থ। পানি দিয়েও এ আগুন নেভানো যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, আগুনের তাপমাত্রা বেশি। এখানে ফায়ার সেফটি ইনসিকিউরড। ফলে আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। তবে আগুন যাতে ছড়িয়ে না পড়ে আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি।

এস আলম সুগার মিলের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হাসমত আলী জানান, কারখানার পুরো প্রসেসিং যন্ত্রপাতি এবং কারখানা নিরাপদ রয়েছে। আগুন যাতে ছড়াতে না পারে, সেজন্য গোডাউন থেকে কারখানার মূল প্ল্যান্টে আসার বেল্ট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।

এস আলম গ্রুপের মানবসম্পদ কর্মকর্তা মো. হোসেন বলেন, সোমবার লাগা আগুনে ৬টি গুদামের মধ্যে একটি গুদামের এক লাখ মেট্রিক টনের বেশি অপরিশোধিত চিনি পুড়ে গেছে। যার বাজার মূল্য হাজার কোটি টাকার বেশি। এখনো গুদামটিতে আগুন জ্বলছে।

এখনো দুটি গুদামে বিক্রি উপযোগী ২৫ থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন চিনি মজুত আছে এবং ৪ লাখ মেট্রিক টনের মতো অপরিশোধিত চিনিও মজুদ রয়েছে বললেন প্রতিষ্ঠানটির এ কর্মকর্তা।

আগুন লাগার ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সার্বিক ও ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় কমিশনার আনোয়ার পাশা। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

জেএন/পিআর

KSRM
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জয়নিউজবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন news@joynewsbd.com ঠিকানায়।

এই বিভাগের আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ

×KSRM