ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশের পতাকাবাহী কয়লাবাহী জাহাজ (বাল্কশিপ) ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জিম্মি করে সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে গেছে জলদস্যুরা।
মঙ্গলবার ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ৪০-৫০ জনের একটি দস্যু দল এমভি আবদুল্লাহ নামের জাহাজটিতে উঠে ক্যাপ্টেনকে জিম্মি করে। এরপর ২৩ নাবিকসহ জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিতে তাদের সময় লাগে মাত্র ১৫ মিনিট।
সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল পূর্বে দুটি নৌযানে (একটি বড় এবং আরেকটি ছোট) চড়ে জাহাজটির কাছাকাছি এসে জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরে নাবিকসহ জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যায়।
মঙ্গলবার (মার্চ ১২) দুপুর ১টার দিকে জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার খবর জানতে পারে পণ্যবাহী জাহাজটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ।
জাহাজের ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানাধীন চট্টগ্রামের এসআর শিপিংয়ের কর্মকর্তাদের জানান, জলদস্যুরা তাদের জাহাজে আক্রমণ করছে। ওই সময় শিপিংয়ের কর্মকর্তারা সেই আক্রমণ যে কোনো মূল্যে ঠেকানোর পরামর্শ দেন।
কিন্তু এর ১৫ মিনিট পরই ক্যাপ্টেনের একটি ই-মেইল বার্তা আসে চট্টগ্রামে। সেখানে তিনি জানান, জলদস্যুরা জাহাজের দখল নিয়ে ফেলেছে। কর্মকর্তারা জানান, দুইদিন আগে রোববার (১০ মার্চ) দুবাইয়ের দিকে যাওয়া ‘এমভি আবদুল্লাহ’র গতিপথ পরিবর্তন করে সোমালিয়ার দিকে ঘুরিয়ে নেয় জলদস্যুরা।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে নাবিকদের সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগ হয়েছে কেএসআরএম কর্তৃপক্ষের। ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখা হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জাহাজের ইন্টারনেট সংযোগও। ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে নাবিকদের কাছে থাকা মোবাইল, সঙ্গে থাকা ডলারও।
৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরের সোমালিয়া উপকূলে জাহাজটির যেতে সময় লাগবে প্রায় তিন দিন। সেখানে পৌঁছার পর জলদস্যু দলের নেতাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে জাহাজ ও তার নাবিকদের ভাগ্য।
ইতিমধ্যে জিম্মি জাহাজের ২৩ নাবিককে পরিচয় জানা গেছে। এর মধ্যে, ৯ জন চট্টগ্রামের বাসিন্দা। বাকিরা দেশের বিভিন্ন জেলার।
ওই জাহাজের ক্রু লিস্ট থেকে জানা যায়, এম ভি আবদুল্লাহর মাস্টার বা ক্যাপ্টেন হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ, চিফ অফিসার হিসেবে রয়েছেন চট্টগ্রামের খান মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ এবং সেকেন্ড অফিসার হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী।
সেই সঙ্গে থার্ড অফিসার হিসেবে রয়েছেন ফরিদপুরের মো. তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট হিসেবে আছেন টাঙ্গাইলের মো. সাব্বির হোসেন।
প্রধান প্রকৌশলী এএসএম সাইদুজ্জামান, দ্বিতীয় প্রকৌশলী মো.তৌফিকুল ইসলাম, তৃতীয় প্রকৌশলী মো. রোকন উদ্দিন, চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ, এবি মো. আনোয়ারুল হক, এবি মো. আসিফুর রহমান, এবি সাজ্জাদ হোসেন, ওএস জয় মাহমুদ, ওএস মো. নাজমুল হক, ওএস আইনুল হক, অয়েলার মোহাম্মদ শামস উদ্দিন, মো. আলী হোসেন, ফায়ারম্যান মোশারফ হোসেন শাকিল, চিফ কুক মো. শফিকুল ইসলাম, জিএস মো. নূর উদ্দিন ও ফিটার মো. সালেহ আহমেদ।
জিম্মি ২৩ নাবিকের মধ্যে বাঁচার আকুতি জানিয়ে অডিও বার্তা দিয়েছেন কেউ কেউ। বর্তমানে জাহাজটি সোমালিয়ার বন্দরে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন জাহাজটির এক নাবিক।
শামসুদ্দিন নামে ওই নাবিক বলেন, ‘মুক্তিপণের জন্যই দস্যুরা আমাদের জিম্মি করেছে। মুক্তিপণ না পেলে অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে পারে। এমনকি আমাদের হত্যাও করতে পারে।
ওই নাবিক তাদের উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ সরকার তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আকুতি জানিয়েছেন। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাতটার দিকে জাহাজটির সব নাবিকের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় জলদুস্যরা।
মুক্তিপণ না দিলে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে জলদস্যুরা
জিম্মি জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ খান তার স্ত্রীর কাছে একটি অডিও বার্তা পাঠিয়েছেন। অডিও বার্তায় আতিক বলেছেন, ‘এই বার্তাটা সবাইকে পৌঁছে দিয়ো। আমাদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে।
ফাইনাল কথা হচ্ছে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলেছে। তাঁদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলেছে। এই বার্তাটা সবদিকে পৌঁছে দিয়ো।’
এ বিষয়ে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম জানান, ‘জাহাজের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। জাহাজের নাবিকরা নিরাপদে রয়েছেন। তাদের উদ্ধারে আন্তর্জাতিক যে প্রক্রিয়া ও কৌশল রয়েছে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে কবির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম জানিয়েছেন, জাহাজে থাকা ২৩ জন ক্রুকে একটি কেবিনে আটকে রেখেছে জলদস্যুরা। তবে সবাই নিরাপদে আছেন।’
তিনি আরও বলেন, মধ্যস্থতাকারী কোনো মাধ্যম খুঁজে না পাওয়ায় জলদস্যুদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তবে এই রকম অবস্থায় আগেও পড়েছিলাম। সামালও দিয়েছি। এবারও আশা করছি পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিতে পারব। জাহাজে জিম্মি নাবিকদের পরিবারের সঙ্গেও আমরা যোগাযোগ রেখে যাচ্ছি। তাদেরকে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য আশ্বস্থ করে যাচ্ছি।
জানা গেছে, ‘গোল্ডেন হক’ নামের জাহাজটি কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং করপোরেশনের বহরে যুক্ত হওয়ার পরে এর নাম হয় ‘এম ভি আবদুল্লাহ’।
২০১৬ সালে তৈরি ১৯০ মিটার লম্বা এই জাহাজটি গত বছর এসআর শিপিংয়ের বহরে যুক্ত হয়। এরপর সাধারণ পণ্য পরিবহন করে আসছিল জাহাজটি।
জাহাজটি সর্বশেষ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে ৪ মার্চ আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। ১৯ মার্চ সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল।
এর আগে, ২০১১ সালের মার্চে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয় বাংলাদেশি ২৬ নাবিকসহ বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি জাহান মনি। তিন মাস পর মুক্ত হয়ে জাহাজটি সোমালিয়া থেকে ওমানের সালালা বন্দরে যায়।
একটি ছোট উড়োজাহাজে করে সোমালিয়ার জলদস্যুদের মুক্তিপণের টাকা পৌঁছে দেয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর তা টেলিফোনে জানান জাহাজটির ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফরিদ।
জেএন/পিআর