‘আমাদের সোমালিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আগামীকাল সেখানে পৌঁছাবো। যতটুকু কথা হয়েছে, সেখানে আমাদের অপর একটি গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করা হবে। আমাদেরকে আটকে রাখা হবে।’
মাঝসমুদ্রে জলদস্যুদের হাতে আটক হওয়া এক নাবিক আত্মীয়ের হোয়াটসঅ্যাপে দেওয়া ভয়েস মেসেজে এসব কথা জানিয়েছেন। যার কপি গণমাধ্যমের কাছে সংরক্ষিত আছে।
বাংলাদেশ সময় বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এ বার্তা পাঠান জলদস্যুদের হাতে আটক হওয়া বাংলাদেশি ইব্রাহীম খলিল উল্ল্যাহ বিপ্লব।
সর্বশেষ বুধবার রাত সাড়ে আটটার দিকে ওই বাংলাদেশির এক আত্মীয় বলেন, ‘দুই ঘণ্টা আগে তিনি (নাবিক) ফেসবুকে অ্যাক্টিভ ছিলেন। তাকে মেসেজ দিলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।’
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন জানান, বুধবার (১৩ মার্চ) সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে এমভি আবদুল্লা সোমালিয়া উপকূল থেকে প্রায় ২৭৫ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল। সেখান থেকে আগামী ২৪ থেকে ৩০ ঘণ্টার মধ্যে সোমালিয়ার কোনো বন্দরে নোঙর করা হতে পারে জাহাজটি।
তিনি বলেন, ‘জলদস্যুদের নিজস্ব চ্যানেল আছে। কয়েকটি গ্রুপ ভাগ হয়ে এ কাজটি করে। যারা জাহাজ ছিনতাই করেছে তারা সোমালিয়া বন্দরে নিয়ে গিয়ে অন্য পার্টির কাছে দিয়ে দেবে। তারাই মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। আমরা মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। এখন পর্যন্ত সেই ধরনের মেসেজ আসেনি। তাদের পদক্ষেপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। বাংলাদেশি নাবিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি।’
গতকাল জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিকউল্লাহ খান এক অডিও বার্তায় জাহাজটির মালিকপক্ষ এস আর শিপিংয়ের কর্মকর্তাদের জানান, সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ’য় ২০ থেকে ২৫ দিনের মতো খাবার আছে। এছাড়া বিশুদ্ধ পানি রয়েছে ২০০ টন। তবে দাহ্য হওয়ায় জাহাজে পরিবহনরত ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
ভারত মহাসাগরে জলদস্যুরা যখন এমভি আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছিল, তখন কৌশলে তিনি এই বার্তা পাঠান।
আতিকউল্লাহ খান বলেন, ‘প্রক্সিমেটলি ২০–২৫ দিনের প্রোভিশন (রসদ) আছে স্যার। ২০০ মেট্রিক টন ফ্রেশ ওয়াটার আছে। আমরা অলরেডি সবাইকে বলছি ফ্রেশ ওয়াটার সেফলি ব্যবহার করতে। প্রোভিসনও (রসদ) আমরা ওভাবে হ্যান্ডেল করব।’
জাহাজে থাকা ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা প্রবলেম হচ্ছে, আমাদের জাহাজে কোল কার্গো আছে। অ্যাবাউট ফিফটি ফাইভ থাউজ্যান্ডস। এটি একটু ডেঞ্জারাস কার্গো, এটা হেজার্ড আছে। এটার মিথেন কনসেনট্রেশন বাড়ে। সর্বশেষ অক্সিজেন লেভেল ৯-১০ পার্সেন্ট ছিল। এটা রেগুলার আপডেট নিতে হয়। ইনক্রিজ হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন হবে।’
ওই অডিও বার্তায় জাহাজে জলদস্যুদের হামলার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘গ্রিনিচ মান সময় ৭টা ৩০ মিনিট (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার দুপুর দেড়টা)। এই সময় একটা হাই স্পিডবোট (দ্রুতগতির স্পিডবোট) আমাদের দিকে আসতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে আল্যার্ম দেই। আমরা সবাই ব্রিজে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার আর জাহাজের দ্বিতীয় কর্মকর্তা ব্রিজে ছিলেন তখন। আমরা এসওএস (জীবন বাঁচানোর জরুরি বার্তা) করলাম। ইউকে এমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন) যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তারা ফোন রিসিভ করেনি। এরপর ওরা (জলদস্যুরা) চলে এল।’
আতিক উল্লাহ খান বলেন, ‘তারা ক্যাপ্টেন স্যার ও দ্বিতীয় কর্মকর্তাকে ঘিরে ফেলল। আমাদের ডাকলো। আমরা সবাই এলাম। এ সময় কিছু গোলাগুলি করল। সবাই ভয় পেয়েছিলাম। সবাই ব্রিজে বসেছিল। তবে কারও গায়ে হাত দেয়নি। এর আগে জিম্মি করা ইরানের মালিকানাধীন একটি মাছ ধরার জাহাজ দিয়ে তারা সাগরে বড় জাহাজ খুঁজছিল। আমাদের জাহাজটি থামিয়েছে তারা। জাহাজের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আমাদেরও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।’
কবির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা জেনেছি, জাহাজে থাকা ২৩ জন ক্রুকে একটি কেবিনে আটকে রেখেছে জলদস্যুরা। তবে তাদের সবাই নিরাপদে আছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখনও মধ্যস্থতাকারী কোনো মাধ্যম খুঁজে পাইনি। জলদস্যুদের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। আমরা বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। তবে যেহেতু আগেও আমাদের এই রকম অবস্থায় পড়তে হয়েছে, ফলে আমরা এবারও পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিতে পারব আশা করছি।’
বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুরে শিল্পগ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ান দস্যুরা। এরপর এদিন বিকেলে জাহাজটি সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সেখানে পৌঁছার পর জলদস্যু দলের নেতাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে জাহাজ ও তার নাবিকদের ভাগ্য।
গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে নাবিকদের সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগ হয়েছে কেএসআরএম কর্তৃপক্ষের। ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখা হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জাহাজের ইন্টারনেট সংযোগও। ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে নাবিকদের কাছে থাকা মোবাইল, সঙ্গে থাকা ডলারও।
জাহাজটি ৫৮ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে ৪ মার্চ আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। ১৯ মার্চ সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। নাবিক ও ক্রুসহ জাহাজটিতে ২৩ জন বাংলাদেশি রয়েছেন। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে জাহাজটিকে ভারত মহাসাগর থেকে সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করে জলদস্যুরা। জাহাজটি ওই সময় সোমালিয়া উপকূল থেকে ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল।
কবির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন ‘এমভি আবদুল্লাহ’ আগে ‘গোল্ডেন হক’ নামে পরিচিত ছিল। ২০১৬ সালে তৈরি বাল্ক কেরিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। গত বছর জাহাজটি এসআর শিপিং কিনে নেয়। বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী এরকম মোট ২৩টি জাহাজ আছে কবির গ্রুপের বহরে।
এর আগে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল বাংলাদেশি জাহাজ জাহান মণি। ওই সময় জাহাজের ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করা হয়। নানাভাবে চেষ্টার পর ১০০ দিনের চেষ্টায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান তারা।
জেএন/এমআর