দুপুর থেকে মধ্যরাত। আলো ঝলমলে শপিংমল থেকে ফুটপাত। ঈদের কেনাকাটায় ধুম লেগেছে চট্টগ্রাম নগরে। ইফতারের বিরতি ছাড়া যেন দম ফেলার ফুসরত নেই বিক্রেতাদের। এই চিত্র চট্টগ্রাম নগরের প্রতিটি শপিংমল আর ফুটপাতের দোকানগুলোতে।
রোববার (৩১ মার্চ) টেরিবাজার এলাকা ঘুরে ঈদ শপিংয়ের এমন দৃশ্য দেখে গেছে।
এটি আন্দরকিল্লা থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে বন্দরনগরীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। বাণিজ্যকেন্দ্র টেরিবাজারে প্রায় ২ হাজার ৫০০ দোকান এবং ৮২টি শপিংমল আছে। শুধু খুচরা গ্রাহকই নয়, জেলার বিভিন্ন উপজেলার ব্যবসায়ীরাও এখান থেকে পাইকারি কাপড় কেনাকাটা করেন।
ব্যবসায়ীদের মতে, ঢাকার ইসলামপুরের পরে এটিই দেশের পাইকারি কাপড়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম কেন্দ্র।
সূত্র জানায়, ২০০০ সাল থেকে এখানে একের পর ওয়ান-স্টপ মল গড়ে উঠেছে, যেখানে সব বয়সের মানুষের জন্য তৈরি পোশাক একই ছাদের নীচে পাওয়া যায়।
বিভিন্ন শপিং মলে সরেজমিনে দেখা গেছে, দুপুরের পর থেকে ক্রেতারা সেহরির পূূব পর্যন্ত কেনাকাটা করেন। প্রতিবারের ন্যায় এবারও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় টেরীবাজার থান কাপড়ের বেচাকেনার ধুম পড়েছে।
শপিং মলগুলোর মধ্যে মল টুয়েন্টি ফোর, সানজানা শপিং মল, মেগামার্ট, মায়াবী, মাসুম ক্লথ স্টোর, সানা ফ্যাশন মল, রাজপরী শপিং মল, জাবেদ ক্লথ স্টোর, মনে রেখো শাড়িজ, শাড়ি কালেকশন, মৌচাক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব দোকানে পরিবারের সব বয়সী সদস্যদের জন্য কাপড়ের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ক্রেতারা। সময়ের হাল আর ফ্যাশন সচেতন ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে এসব শপিং মলগুলোর আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে।
টেরিবাজার এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, গত দুই বছরের তুলনায় কাপড়ের মূল্য বেড়েছে প্রায় ৪২ শতাংশ। আমদানি খরচ বাড়তি থাকার কারণে কাপড়ের দাম বেড়েছে বলে জানান দোকানিরা। টেরিবাজারের পাইকারি বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘গত এক বছরের তুলনায় কাপড়ে আমদানি খরচ বেড়েছে। এছাড়া দেশিয় কাপড় উৎপাদনের খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি।’
মল টুয়েটি ফোরের মালিক রেজা বলেন, ‘সারা বছরের মোট বিক্রির ৪০ শতাংশই হয় রমজানে। ঈদ উপলক্ষে ক্রেতাদের চাহিদার দিকটা মাথায় রেখে এবার বিদেশ থেকে কাতান, লিলেন, জামদানি, সুতি, নেট, জর্জেট, শিপন ও ডিজিটাল প্রিন্টের হরেক রকম কাপড় আমদানি করা হয়েছে।পাশাপাশি দেশি কাপড়ের চাহিদাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে।বন্ধের দিন থাকায় গত দুদিন ব্যবসা ভালো হয়েছে। তবে দ্রবমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের টার্গেট পূরণ করা সম্ভব কিনা এ বিষয়ে সন্দিহান।’ ‘করোনা দখল কাটিয়ে গেল ২২ ও ২৩ সাল মোটামুটি বেচাবিক্রি বেড়েছিল। কিন্ত বর্তমানে মূলস্ফীতির সময় সাধারণ মানুষের ঈদবাজারে আগ্রহ কম থাকতে পারে। তবে আমাদের প্রস্তুতি আছে। আশা করি চলতি সপ্তাহ থেকে বিক্রির পরিমাণ বাড়বে।’
কেনাকাটার করতে সন্তানদের নিয়ে এসেছিলেন তামান্না বিনতে রাশেদ। তিনি বলেন, ‘ওয়ান স্টপ মলে কেনাকাটা করার সুবিধা হলো এখানে পরিবারের সবার জন্য একই ছাদের নীচে সব ধরনের পোশাক পাওয়া যায়। পোশাক কেনার জন্য আমাকে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে যেতে হবে না এবং দামও যুক্তিসঙ্গত।’
মেগামার্ট শপিং মলের হেড অফ মার্কেটিং শামু দে বলেন, আমাদের এখানে থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, কুর্তি, শাড়ি, লেহেঙ্গা, শার্ট প্যান্টের কালেকশন রয়েছে। এর মধ্যে মেয়েদের জন্য এসেছে ভারতীয় কাপড় শারারা, গারারা। এর দাম পড়বে এক হাজার ৮৫০ থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত বেচা-কেনা বেশ ভালো। আশা করছি সামনের দিনগুলোতে বিক্রি আরও বাড়বে।
বান্ধবীসহ ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুসরাত খন্দকার। তিনি বলেন, দুদিন আগেও একবার এসেছিলাম, কেনা হয়নি। আজ বান্ধবী থ্রিপিস পছন্দ করে দেবে বলে আবার আসলাম।’
সানজানা শপিং মলের কর্ণধার আলমগীর বাদশা বলেন, “বাছাই করে পোশাক কেনার সুযোগ টেরিবাজারে বেশি। দামও তেমন বেশি নয়। তাই ক্রেতারা এখানে বেশি আসেন।”
তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মেয়েদের আকর্ষণীয় শাড়ির প্রতি চাহিদা ছিল বেশি। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও দেখছেন শাড়ি। এর মধ্যে লিলেন, জামদানি, কাতান, কটন, নেট, জর্জেট, শিফন প্রভৃতি অন্যতম।
মনেরেখো শপিং মলের এক বিক্রেতা বলেন, প্রতি ঈদেই শাড়ির চাহিদা থাকে। বিশেষ করে পরিবারের সদস্যরা এক সঙ্গে শাড়ি দেখে কেনেন। ঈদে দেশি সুতি শাড়ির চাহিদা বেশি।
নগরের ঈদবাজারে সাবার পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে আদি মোহিনী মোহন কাঞ্জিলাল। লালদীঘির উত্তরপাড়ে ফয়েজ আলী সিটি সেন্টারের তৃতীয় ও চতুর্থ তলাজুড়ে ভারতের বিখ্যাত শাড়ির ব্রান্ডটির বিশাল শো-রুম। গত বছরের জুলাই-আগস্টে উদ্বোধন হয় এটি। তাদের বাংলাদেশে দ্বিতীয় শাখা। এখানে আছে নারীর পছন্দের শাড়ির বৈচিত্র্যময় ডিজাইনের কালেকশন। কুর্তি, লেহেঙ্গা, থ্রিপিস, গাউন, গহনা, ইনার ওয়্যার, ব্যাগ ইত্যাদিও পাওয়া যাচ্ছে।
বিক্রয়কর্মী মোহাম্মদ সবুজ বলেন, শাড়ির মধ্যে গাদোয়াল সিকো ১১ থেকে ২২ হাজার, পিওর গাদোয়াল ২৫-৪০ হাজার, দিল্লি বুটিকস ৫-২২ হাজার, ইতকাত ২ হাজার ৯৯০-২২ হাজার, বোমকাই ১ হাজার ৬৫০, অপেরা কাতান সাড়ে তিন থেকে ২০ হাজার, কাঞ্জিবরণ ২ হাজার ২৫০ থেকে ৩৫ হাজার, ইন্ডিয়ান জামদানি সাড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার, কাশ্মীরি সিল্ক ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার, হ্যান্ডলুম শাড়ি পিওর কটন সাড়ে তিন থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার, খাড্ডি শাড়ি ৬ থেকে ২২ হাজার, পিওর কাঞ্জিবরণ ১৮ থেকে ৪০, বেনারসি ৮ থেকে ৪৫ হাজার, হাতের কাজ করা বিয়ের শাড়ি ১২ থেকে ৩৫ হাজার, কোটা শাড়ি ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা। এর বাইরে নিত্যনতুন ডিজাইনের শাড়ি আসছে শো-রুমে।
তিনি জানান, আমাদের শাড়ির অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে স্টান্ডার্ড মাপ আর কোয়ালিটি। সব শাড়ি স্বর্ণালি কাঞ্জিলালের নিজস্ব ডিজাইনে করা হয়। রমজান উপলক্ষে সকাল ১০টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত শো-রুম খোলা থাকছে। ঈদের আগে সেহেরি পর্যন্ত খোলা রাখা হবে। একদামে বিক্রি করি আমরা। বিক্রির সাত দিনের মধ্যে শাড়ি বদলানোর সুযোগ রয়েছে।
টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমিনুল হক বলেন, ‘এই ঈদ বাজারে টেরিবাজারের ব্যবসায়ী মহলে এখনো কোনো টার্গেট নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। গত বছরেও ১৬ রমজানের আগে বেচাবিক্রির ধুম পড়ে গিয়েছিল। কিন্ত এই বছরের চিত্র ভিন্ন। তবু আমরা আশাবাদী, চলতি সপ্তাহে বিক্রি বাড়বে।’
জেএন/হিমেল/এমআর