ইউরোপের অনেক বন্দর শহরে বিশালাকার ক্রুজ জাহাজের আগমন বিরক্তি ও ক্ষোভের কারণ হয়ে উঠছে। পরিবেশ দূষণ ও মাত্রাতিরিক্ত ভিড়ের কারণে অনেক শহর এমন জাহাজ নিষিদ্ধ করছে।
ইউরোপের অনেক শহর ‘ক্রুজ কনট্রোল’ করতে চায়। পর্যটকদের জনপ্রিয় গন্তব্য হিসেবে ভেনিস ও বার্সেলোনার মতো শহর কেন্দ্রস্থলে বড় আকারের যাত্রীবাহী জাহাজ নোঙর করা নিষিদ্ধ করেছে। পরিবেশ দূষণ ও শহরের কেন্দ্রস্থলে ভিড় কমাতে এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
‘ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড এনভারনমেন্ট’ নামের এনজিও গত জুন মাসে এক গবেষণার ফল প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বিলাসবহুল ক্রুজ শিল্পের কারণে গোটা ইউরোপে দূষণ বাড়ছে। যে সব শহর এমন জাহাজ নিষিদ্ধ করছে, সেখানে পরিবেশগত সুফল টের পাওয়া যাচ্ছে।
ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড এনভারনমেন্টের কনস্টানৎসে ডেইকস্ট্রা জানান, ‘‘২০১৯ সালে ভেনিস সবচেয়ে দূষিত ক্রুজ শিপ শহর ছিল। বিস্ময়করভাবে ২০২২ সালে সেটি ৪০তম অবস্থানে নেমে গেছে।
নিষেধাজ্ঞার কারণে বড় ক্রুজ জাহাজের পক্ষে সেই শহরে নোঙর করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠায় এমনটা ঘটেছে।”
অন্যান্য বন্দর শহরও এমন দৃষ্টান্ত খতিয়ে দেখছে। বেলজিয়ামও সে বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করছে। সে দেশের ডাচভাষী অঞ্চলের পর্যটন বোর্ড ‘ভিজিট ফ্লান্ডার্স’ অ্যান্টওয়ার্প, ব্রুজ ও গেন্ট শহরে ক্রুজ পরিবহণ সম্পর্কে সমীক্ষা চালিয়ে জানতে পেরেছে, যে প্রতিটি শহরের অর্ধেকের বেশি মানুষ মনে করেন, যে তাদের পরিবেশের উপর জাহাজের কুপ্রভাব রয়েছে।
‘ভিজিট ফ্লান্ডার্স’ সংগঠনের সাস্টেনিবিলিটি ম্যানেজার হিসেবে মারইয়ান নাউভেলের্ট সেই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
অ্যান্টওয়ার্প শহরে তাঁর দপ্তরের জানালা দিয়ে দূরের বন্দরে নোঙর করা এক ক্রুজ জাহাজ চোখে পড়লো। তাঁর মতে, কার্বন নির্গমনই বাসিন্দাদের দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ।
তিনি বলেন, ‘‘বিশেষ করে অ্যান্টওয়ার্পে বাতাসের মান আসলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। সেখানে ‘লো এমিশন জোন’ আছে। বার বার কার উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থাৎ, মানুষ বলেছে, আমরা লো এমিশন জোনে থাকি। অথচ সেখানেই এমন জাহাজ নোঙর ফেলছে, যা চালাতে বিশাল জ্বালানি লাগে।”
বেলজিয়ামের ব্রুজ শহরে বিরোধিতার মাত্রা সবচেয়ে বেশি। অথচ শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে জাহাজ থামে। এক সাম্প্রতিক জনমত সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় ৭০ শতাংশ বাসিন্দা অনেক কম ক্রুজ যাত্রী চান।
অন্যদিকে অ্যান্টওয়ার্প শহরের বেশি মানুষ ক্রুজ পর্যটনের পক্ষে। লেজেন্ডস অফ অ্যান্টওয়ার্পের গাইড লু ডিলেন বলেন, ‘‘সবাই এখানে পর্যটক চায়। তাদের সংখ্যা বেশি নয়। ভেনিসের মতো শহরে অতিরিক্ত পর্যটক আসেন। এখানকার অবস্থা স্বাভাবিক।”
ফিনল্যান্ডের মায়ার টুর্কু কোম্পানির তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রমোদতরিতে ২০টিরও বেশি রেস্তোরাঁ, সাতটি সুইমিং পুল ও সীমাহীন মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা রয়েছে। সেই জাহাজ প্রায় ৭,৬০০ মানুষ বহন করতে পারে। জানুয়ারি মাসে ফ্লোরিডা থেকে সেটি রওয়ানা হয়েছে।
কোম্পানির কর্ণধার টিম মায়ারের মতে এমন অল ইনক্লিউসিভ ব্যবস্থা আরো পরিবেশ সচেতন হওয়ার সুযোগও দেয়।
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের জাহাজে সবই আছে এবং সবটাই এক প্রণালী। আমরা জ্বালানির ব্যবহার আদর্শ করতে পেরেছি। প্রতিবার আমরা প্রোটোটাইপ তৈরি করি।
ফলে এবার মাথাপিছু ব্যবহারও কমাতে পেরেছি। যাত্রী প্রতি ২০ শতাংশ কম জ্বালানি খরচ হচ্ছে।”
আইকন অফ দ্য সিজ’ নামের জাহাজ তরল প্রাকৃতিক গ্যাস ও ফুয়েল সেল প্রযুক্তিতে চলছে। বন্দরে নোঙর ফেলার পর জাহাজে স্থানীয় বিদ্যুৎ সংযোগ করা যাচ্ছে।
২০৩০ সাল থেকে ইউরোপের সব বন্দরে সেই নিয়ম বাধ্যতামূলক করা হবে।
ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড এনভারোনমেন্টের কনস্টানৎসে ডেইকস্ট্রা বলেন, ‘‘ইউরোপকে সেটা বাধ্যতামূলক করতে হয়েছে। কারণ এখনো পর্যন্ত ক্রুজ শিপ উপকূলের বিদ্যুৎ সংযোগ চায় নি। কারণটাও খুব সহজ।
নোংরা জ্বালানি পুড়িয়ে অনেক সস্তায় হোটেল ও সুইমিং পুল চালানো যায়। বন্দরের বিদ্যুৎ সংযোগের দাম অনেক বেশি।”
ক্রুজ শিল্পখাতের কয়েক জন কর্তাব্যক্তি ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনহীন ক্রুজের ডাক দিচ্ছেন। কিন্তু কোন জাহাজকে কত মূল্য দিয়ে বন্দরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে, এখন থেকে সেই সময় পর্যন্ত শহরগুলিকে সেই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জেএন/পিআর